শ্রীশ্রী গঙ্গাদেবীর নদীরূপ ধারণ, শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ হতে বিস্তারিত
শ্রীশ্রীগঙ্গাদেবীর নদীরূপ ধারণ | শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ হতে বিস্তারিত...
শ্রীগঙ্গাদেবী নিত্য চিন্ময় লোকে অমৃত বারিধারা। পতিত লোকদের উদ্ধারের জন্য তাঁর আগমন। তিনি কোন বিশেষ কারণকে উপলক্ষ্য করে জড় জগতে আসেন। শ্রীগঙ্গাদেবী ও শ্রীসরস্বতীদেবী পরস্পর কলহ করে পরস্পরের অভিশাপে উভয়ে নদীরূপ লাভ করেছেন। শ্রীব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এ কাহিনী বর্ণিত আছে। উক্ত পুরাণে দেবর্ষি নারদকে ভগবান শ্রীনারায়ণ বললেন-শ্রীলক্ষ্মীদেবী, গঙ্গাদেবী, শ্রীসরস্বতীদেবী - এই তিনজন শ্রীহরির ভাৰ্য্যা। তাঁরা সর্বদা শ্রীহরির সমীপেই বাস করেন। একদিন গঙ্গাদেবী মৃদু মধুর হাস্য শোভিত হয়ে প্রভু শ্রীহরির প্রতি কটাক্ষপাত পূর্বক তদীয় শ্রীমুখপদ্ম অবলোকন করছিলেন। প্রভু শ্রীহরিও তার প্রতি ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করে মৃদুহাস্য করলে লক্ষ্মীদেবী কিছু মনে করলেন না, কিন্তু দেবী সরস্বতী রেগে কম্পিত হলে তাঁর মুখ এবং নয়নযুগল রক্ত বর্ণ হলো। এই অবস্থায় সরস্বতী দেবী শ্রীহরিকে বললেন-পতি যদি শ্রেষ্ঠ এবং ধার্মিক হন তাহলে স্ত্রীদিগের প্রতি সমতা বুদ্ধি থাকে। কিন্তু,অর্থাৎ, হে গদাধর! গঙ্গার অধিক সৌভাগ্যের কথা অর্থাৎ গঙ্গার প্রতি আপনার অধিক প্রণয়ের বিষয় আমি জানতে পারলাম। লক্ষ্মীর প্রতিও আপনার অধিক প্রণয় আছে তাও বুঝতে পারলাম। হে প্রভো! আমার প্রতি আপনার প্রণয় কিছুই নেই-এটি আমি এখন জানতে পারলাম। গঙ্গার সহিত লক্ষ্মীর (পদ্মার) সজ্জন তুল্যা প্রীতি আছে, তাই শ্রীহরির বিপরীত ভাব দেখেও লক্ষ্মী কিছু মনে করে নাই। আমি অতিশয় দুর্ভাগিণী, তাই আমি শ্রীহরির প্রণয় হতে বঞ্চিতা, আমার জীবন ধারণ নিস্ফল। সরস্বতী দেবীর এই প্রকার উক্তি শ্রবণ করে তাঁকে ক্রোধাবিষ্টা দেখে প্রভু শ্রীহরি বাইরে চলে গেলেন। শ্রীহরি বাইরে চলে গেলে দেবী সরস্বতী ক্রোধভরে গঙ্গাদেবীকে অনেক শ্রুতি কটুবাক্য বললেন এবং রেগে গঙ্গাদেবীকে কেশাকর্ষণ করতে উদ্যতা হলেন। তখন লক্ষ্মীদেবী দেবী সরস্বতী ও গঙ্গাদেবীকে মধ্যস্থলে এসে দেবী সরস্বতীকে বিবাদ করতে নিবারণ করলেন-তারপর,
অর্থাৎ, সরস্বতী দেবী তখন অত্যধিক রেগে গিয়ে সেই লক্ষ্মীদেবীকে অভিশাপ প্রদান করলেন। কেননা লক্ষ্মীদেবী বিপরীত ভাব দেখেও কিছু বলেন নাই। পরন্তু এই সভামধ্যে বৃক্ষ ও নদীর ন্যায় অবস্থান করত নির্বাক থেকে সরস্বতীর গতিরোধ করল। তাই সরস্বতী দেবী বৃক্ষরূপা ও নদী রূপা হবার অভিশাপ প্রদান করলেন।সরস্বতীদেবীর অভিশাপ বাক্য শ্রবণ করেও লক্ষ্মীদেবী কোন প্রকার প্রত্যাভিশাপ করলেন না বা রেগেও গেলেন। মনোদুঃখে সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। গঙ্গা দেবী কিন্তু বলতে লাগলেন-পদ্মে! তুমি অত্যুগ্রা বাণীকে ছেড়ে দাও। এই বাণীর বাক্য ক্রূর এবং সে কলহপ্রিয়া। এর কত শক্তি আছে তা নিয়ে আমার সাথে বিবাদ করুক।
অর্থাৎ, গঙ্গাদেবী বললেন- হে লক্ষ্মীদেবী! এই দুষ্টা সরস্বতী তোমাকে যেভাবে নদী হবার অভিশাপ দিয়েছে সেরূপ সে নিজেই নদীরূপা হোক অর্থাৎ সরস্বতী শাপগ্রস্ত হয়ে নদী হয়ে যাক। অধোলোকে মর্ত্যে সেখানে পাপীরা বাস করে এই বাণী সরস্বতী সেখানে গমন করুক এবং তথায় কলিকালে পাপীগণের সমস্ত পাপ ভাগ লাভ করবে, এতে কোন সন্দেহ নাই। গঙ্গাদেবীর এই শাপ বাক্য শ্রবণ করে সরস্বতীদেবীও গঙ্গা দেবীকে এইই বলে অভিশাপ দিলেন যে, তুমিও পৃথিবীতে গমন করে নদীরূপা হয়ে পাপী গণের পাপভাগ লাভ করবে। এভাবে গঙ্গাদেবী ও সরস্বতী দেবী উভয়ে যখন পরস্পর শাপদানে রত ছিলেন। তখন ভগবান শ্রীহরি চারিপার্ষদ সেখানে আবির্ভূত হলেন এবং তাঁদের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়ে সময়োচিত কথা বললেন। তারপর শ্রীহরি লক্ষ্মীদেবীকে বললেন লক্ষ্মী! তুমি নিজকলা (ষোড়শ ভাগের এক ভাগ) দ্বারা রাজ ধর্মধ্বজের গৃহে তার কন্যা রূপে জন্ম নাও। সেখানে তুমি আমারই অংশজাত শঙ্খচূড়ের পত্নী হয়ে তুমি তুলসী নামে বিখ্যাতা হবে। সুবদনে! তুমি কলা দ্বারা সরস্বতীর শাপ বশতঃ পদ্মাবতী নামে নদী হবে। তারপর ভগবান শ্রীহরি গঙ্গাদেবীকে বললেন-
অর্থাৎ, শ্রীভগবান বললেন— গঙ্গে! তুমিও অংশ (চারিভাগের একভাগ) দ্বারা বিশ্বপাবনী হয়ে ভারতীয় শাপবশতঃ ভারতে দেহধারী মনুষ্যাদি সকলের পাপদহনের জন্য গমন কর। রাজা ভগীরথ অতি দুষ্কর তপোবলে তোমাকে ভূতলে নিয়ে যাবে, তথায় তুমি "ভাগীরথী গঙ্গা" নামে খ্যাতি লাভ করে পুণ্যা নদী হবে। তারপর শ্রীহরি সরস্বতীকে বললেন-তুমি গঙ্গার শাপ দ্বারা ভারতবর্ষে গমন করে নদীরূপ লাভ কর এবং দুই সপত্নী লক্ষ্মী ও গঙ্গাদেবীর সহিত বিবাদের ফল ভোগ কর। লক্ষ্মীদেবী শ্রীহরিকে বললেন- হে নাথ! আমরা যদি ভারতবর্ষে গমন করি তবে কতদিনে অভিশাপ হতে মুক্ত হয়ে পুনরায় আপনাকে লাভ করতে পারব? লক্ষ্মীদেবীর কথা শ্রবণ করে ভগবান বললেন-
অর্থাৎ, কলিকালের পাঁচহাজার বছর অতিক্রান্ত হলে পরে নদীরূপা তোমাদের মুক্তিলাভ হবে। তখন তোমরা পুনরায় আমার ভবনে ফিরে আসবে।