জন্মাষ্টমী উপবাস পালনের শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত | জন্মাষ্টমী সূর্যোদয়বিদ্ধা হলে পরিত্যাজ্য
জন্মাষ্টমী উপবাস পালনের শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত | জন্মাষ্টমী সূর্যোদয়বিদ্ধা হলে পরিত্যাজ্য
কেউ কেউ মনে করেন— "অরুণোদয়ে দশমীবিদ্ধা হলে একাদশী যেমন বর্জিতা হয়, তেমনি অরুণোদয়ে সপ্তমী বিদ্ধা হলে জন্মাষ্টমী বর্জিতা" কিন্তু তা সুসঙ্গত নয়। কারণ, একাদশী ছাড়া অন্য তিথিসকল সূর্যোদয়ে আরম্ভ হলে সম্পূর্ণা লক্ষণ তথা শুদ্ধা হয়। সম্পূর্ণা তিথিতে বিদ্ধত্বারোপ মূঢ়তা মাত্র।
জন্মাষ্টম্যাঞ্চ শুদ্ধায়া-মুপোষ্য কেবলং নরঃ। অশ্বমেধফলং তস্য ব্রতং জাগরণং বিনা॥
যদ্বাল্যে যচ্চ কৌমারে যৌবনে যচ্চ বার্দ্ধকে। সপ্তজন্মকৃতাৎ পাপান্মুচ্যতে নাত্ৰ সংশয়ঃ॥
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৮.৭৩-৭৫)
গৌড়ীয় বৈষ্ণব-আচার্য প্রবর শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভু 'প্রমেয় রত্নাবলী' গ্রন্থে (৮ম প্রমেয়-৯ শ্লোকে) স্পষ্টভাবে লিখেছেন-
অর্থাৎ, "কেবল একাদশী ব্রতেই অরুণোদয় বিদ্ধা পরিত্যাজ্য, কিন্তু জন্মাষ্টমী প্রভৃতি অন্য সমস্ত ব্রত কেবল সূর্যোদয়বিদ্ধা হলেই ত্যাজ্য।"
শ্রীহরিভক্তিবিলাসধৃত (১৫/৩৬১) পদ্মপুরাণে বলা হয়েছে-
"দশমী বিদ্ধা একাদশী শ্রবণা নক্ষত্রযুক্তা হলেও যেমন বর্জনীয়া, সেরূপ রোহিণী নক্ষত্র যুক্তা হলেও সূর্যোদয়ে সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী বিশেষভাবে বর্জন করবে।"
শ্রীচৈতন্যমঠ ও শ্রীগৌড়ীয় মঠসমূহের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-মধ্য লীলা ২৪ পরিচ্ছেদে ৩৩৭ পয়ারের অনুভাষ্যে লিখেছেন-"একাদশীতে অরুণোদয়বিদ্ধা ত্যাগ এবং অন্য ব্রতে সূর্যোদয়বিদ্ধা ত্যাগ করে অবিদ্ধাব্রতই পালনীয়। বিদ্ধাব্রত পালনে 'দোষ' এবং অবিদ্ধাব্রত পালনেই ভক্তি হয়।” শ্রীহরিভক্তিবিলাস (১৫.৩৭১) অনুসারে,
"সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী ব্রত করা যায়- এ ধরনের বিধান অবৈষ্ণবগণের পক্ষে এবং দেবমায়া দ্বারা কৃত।" সুতরাং, সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমীতে বৈষ্ণবগণ কখনো ব্রতাচরণ করবেন না।
পদ্মপুরাণের স্বর্গখণ্ডে ৪৩তম অধ্যায়ে (১২২-১২৪, ১৩০) বলা হয়েছে-
অর্থাৎ, "তৃতীয়া, ষষ্ঠী, অষ্টমী, একাদশী ও চতুর্দশী কখনো পূর্ববিদ্ধা করবে না। সপ্তমীসংযুক্তা অষ্টমী বর্জনপূর্বক নক্ষত্র ব্যতীতও নবমীসংযুতা অষ্টমীতেই ব্রত করবে।"
"যদি সূর্য-উদয়কালে কিঞ্চিৎ অষ্টমী, আর সমস্ত দিনরাত্রিই নবমী হয় এবং মুহূর্তপ্রমাণ রোহিণী নক্ষত্র থাকে, তবে সেদিনই সম্পূর্ণ অষ্টমী হবে।" (অর্থাৎ, সূর্য-উদয়কালে অষ্টমী না হয়ে সপ্তমী থাকলে, তা সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী; অতএব তা বর্জনীয়।) তাই বলা হয়েছে—
"সপ্তমী দ্বারা পলমাত্র (খুবই স্বল্পকাল) বেধ হলেও সে অষ্টমীকে সুরাবিন্দু দ্বারা স্পৃষ্ট গঙ্গাজল কলসের ন্যায় তা পরিত্যাগ করবে।"
আবার, কেউ মনে করেন, পরবিদ্ধা অর্থাৎ, কেবল নবমীযুক্তা অষ্টমীতেই জন্মাষ্টমীর উপবাস করতে হবে, এটাও ভ্রম। সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী পরিত্যাগ করে নবমীযুক্ত অষ্টমীতে উপবাস করতে হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু যে স্থলে অষ্টমীতে সপ্তমীবিদ্ধা নেই অর্থাৎ, সূর্যোদয়ে সপ্তমী স্পর্শ হয়নি, সে স্থলে শুদ্ধা অষ্টমীতেই উপবাস করতে হবে। যদি অষ্টমী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পরের দিনও কিছুকাল থাকে, তাহলে পরের দিন অষ্টমীর শেষে পারণ করতে হবে, এই প্রকার স্পষ্ট নির্দেশ শ্রীহরিভক্তিবিলাসে আছে। সকলক্ষেত্রেই মাত্র নবমীযুক্তা অষ্টমীতে উপবাসের ব্যবস্থা থাকলে পারণের এরূপ ব্যবস্থা হতো না। পূর্ববিদ্ধা পরিত্যাগ করে শুদ্ধা তিথিতে উপবাসই সাধারণত সর্বত্র দৃষ্ট হয়।
"অষ্টমী ব্রত সর্বদা নবমীবিদ্ধা কর্তব্য, সপ্তমী বিদ্ধা কিন্তু সর্বদা বর্জন করবে। কারণ, সপ্তমী-বিদ্ধা অষ্টমী পূর্বকৃত পুণ্যকে ধ্বংস করে। সপ্তমী বিদ্ধা অষ্টমীর উপবাসে হরিবৈমুখ্যবশত ব্রহ্মহত্যা পাপ দান করে।"
"ব্রতী সপ্তমীযুক্ত অষ্টমী যত্নপূর্বক বর্জন করবে। সপ্তমীসহ অষ্টমী রোহিণীনক্ষত্রযুক্তা হলেও সর্বতোভাবে বর্জনীয়া।
সূর্যোদয়ে সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী পরিত্যাগ করে নবমীযুক্ত জন্মাষ্টমী ব্রতের দৃষ্টান্তস্বরূপ, ইস্কন জিবিসি ক্যালেন্ডার অনুসারে, বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত সময়মান (23N43 90E25, +6) হিসাবে ইস্কন বাংলাদেশ প্রকাশিত পঞ্জিকা অনুসারে,
২০১৯ সালের জন্মাষ্টমীর উপবাস-দিন নির্ণয় উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরা হলো।
২৩ আগস্ট : সূর্য-উদয়- ৫টা ৩৬ মি. ৪৩ সে.
২৩ আগস্ট : অষ্টমী তিথি শুরু হয়েছে সকাল ৮টা ৪১ মি. ৩৪ সে.।
অর্থাৎ, ২৩ আগস্ট সূর্য-উদয়কালে সপ্তমী তিথি ছিল, অষ্টমী ছিল না। সুতরাং, এদিন সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী বলে তা বর্জনীয়। তাছাড়া সেদিন রোহিণী নক্ষত্রও ছিল না।
২৪ আগস্ট : সূর্য-উদয়- ৫টা ৩৭ মি. ০৫ সে.
২৪ আগস্ট : নবমী তিথি শুরু হয়েছিল সকাল ৯টা ৪মি. ২৭ সে. এবং রোহিণী- নক্ষত্র শুরু ভোর ৪টা ১৮মি. ৩০ সে. থেকে পরদিন ভোর ৪টা ৪৬মি. ৫৬ সে. পর্যন্ত।
অর্থাৎ, এদিন সূর্যোদয়কালে অষ্টমী তিথি ছিল, আর সমস্ত দিনরাত্রিই নবমী এবং সেই সাথে রোহিণী নক্ষত্রও ছিল। সুতরাং, সবমিলিয়ে শাস্ত্রসিদ্ধান্ত অনুসারে এই দিন তথা ২৪ আগস্টই জন্মাষ্টমী উপবাসের উপযুক্ত দিন।