মধুবন মাহাত্ম্য, মহলী গ্রাম, শ্রীকৃষ্ণকুণ্ড, শ্রীবলরাম ও শ্রীশত্রুঘ্ন মন্দির এবং শ্রীবল্লভাচার্যের বৈঠক | ধ্রুব মহারাজের তপস্যা স্থান

মধুবন মাহাত্ম্য,মহলী গ্রাম,শ্রীকৃষ্ণকুণ্ড,শ্রীবলরাম ও শ্রীশত্রুঘ্ন মন্দির এবং শ্রীবল্লভাচার্যের বৈঠক | ধ্রুব মহারাজের তপস্যা স্থান

শ্রীপদ্মপুরাণে বলা হয়েছে-

ভদ্র-শ্রী-লৌহ-ভাণ্ডীর-মহা-তাল-খদিরকাঃ ।
বহুলা কুমুদং কাম্যং মধু বৃন্দাবনং তথা
দ্বাদশৈতান্যরণ্যানি, কালিন্দাঃ সপ্ত পশ্চিমে।
পূর্বে পঞ্চবনং প্রোক্তং তত্রাস্তি গুহ্যমুত্তমম্ ॥

অর্থাৎ, ভদ্ৰবন, শ্রীবিল্ববন, লৌহবন, ভাণ্ডিরবন, মহাবন, তালবন, খদিরবন, বহুলাবন, কুমুদবন, কাম্যবন, মধুবন আর বৃন্দাবন-এই দ্বাদশ বন/তার মধ্যে সাতটি বন যমুনার পশ্চিম তীরে এবং পাঁচটি বন যমুনার পূর্বতীরে অবস্থিত।

প্রথমং মধুবনং প্রোক্তং দ্বাদশং বৃন্দিকাবনম্।
এতানি যে প্রপশ্যন্তি ন তে নরক ভোজিনঃ ॥

অর্থাৎ, প্রথম মধুবন হতে দ্বাদশবন বৃন্দাবন পর্যন্ত বনসমূহকে যারা কেবলমাত্র দর্শন করেন তাদের আর নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় না। হে দেবী! মধুবন নামে বিষ্ণুধাম রমণীয় ও সর্বোৎকৃষ্ট, যার দর্শনে মানব সর্ব অভীষ্ট লাভে সমর্থ হন। সেই বনে নীল পদ্ম শোভিত স্বচ্ছ জলপূর্ণ কুণ্ড আছে, সেই কুণ্ডে লোক স্নানদানের দ্বারা বাঞ্ছিত ফল লাভ করে থাকেন।

মধুবন বৃন্দাবন

মধুবন দ্বাদশ বনের প্রথম বন। মথুরা শহর হতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তিন মাইল দূরে মধুবন অবস্থিত। এই স্থানের বর্তমান নাম মহলী। শ্রীভগবান এই বনে শ্রীমধুদৈত্যকে বিনাশ করেছিলেন, তাই এই বনের নাম মধুবন। গ্রামের পূর্বে ধ্রুবটীলা অবস্থিত। এখানে টীলার উপরে বসে শ্রীধ্রুব মহারাজ কঠোর তপস্যায় মগ্ন থাকতেন। গ্রামের নৈঋত কোনে মধুকুণ্ড বিরাজমান।

ধ্রুবটীলাঃ

এই টীলার উপরে শ্রীধ্রুব মহারাজ কঠোর তপস্যা করে শ্রীভগবানের দর্শন লাভ করেছিলেন। টীলার উপরে একটি সুন্দর মন্দির বৃক্ষাদিতে ঘেরা। মন্দিরে ভগবান শ্রীনারায়ণ, ধ্রুব মহারাজ এবং শ্রীনারদ মুনির শ্রীবিগ্রহ বিদ্যমান।

শ্রীধ্রুব মহারাজের তপস্যার সংক্ষিপ্ত কাহিনীর বর্ণনা প্রদান করা হলো। স্বায়ম্ভুব মনুর কনিষ্ঠপুত্র উত্তানপাদ। উত্তানপাদের সুরুচি ও সুনীতি নামে দু'জন স্ত্রী। ভাগ্যবতী সুরুচির পুত্র উত্তম আর সুনীতির পুত্র ধ্রুব। একদিন উত্তানপাদ পুত্র উত্তমকে ক্রোড়ে নিয়ে রাজসিংহাসনে উঠার চেষ্টা করলে বিমাতা সুরুচি ধ্রুবকে বহু তিরস্কার করলেন। ধ্রুব রোদন করতে করতে নিজ মায়ের নিকট গিয়ে বিমাতার তিরস্কার ও পিতার অনাদরের কথা জানালেন। সুনীতি পুত্র ধ্রুবের দুঃখ দেখে তাকে সান্ত্বনা প্রদান করে উচ্চপদ লাভের জন্য হরিভজনের উপদেশ দিলেন। অতঃপর ধ্রুব মাতার উপদেশে তপস্যার জন্য বনে গমন করেন। শ্রীনারদ মুনি এসে ধ্রুবকে তপস্যার দৃঢ়তার জন্য অনেক পরীক্ষা করলেন কিন্তু ধ্রুবকে তার প্রতিজ্ঞায় অটল দেখে ধ্রুবকে দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্রে উপদেশ প্রদান করলেন। সাধনের সকল বিধানাদি বলে দিয়ে তিনি ব্রজের মধুবনে যেতে আজ্ঞা দিলেন । শ্রীবৃন্দাবন লীলামৃতে-

শুন বাপু ধ্রুব তুমি যাহ মধুপুরে।
শ্রীকৃষ্ণ সাধন কর যমুনার তীরে ॥
সেই স্থান হয় কৃষ্ণের অতি প্রিয়তম।
চিন্তা না করিহ তুমি পাবে দরশন ॥
সে মন্ত্র জানিয়া কৃষ্ণ পূজা নিরন্তর।
ত্ৰৈলোক্য বন্দিত পদ দিবে গদাধর ॥

একথা বলে নারদ মুনি রাজা উত্তানপাদ সমীপে গিয়ে ধ্রুবের প্রসঙ্গ বর্ণন করলে রাজা নিশ্চিন্ত হলেন। এদিকে ধ্রুব তখনি যমুনার তটে মধুবনে গিয়ে কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হলেন। ধ্রুবের তপোবল দেখে শ্রীভগবান মধুবনে উপস্থিত হলেন। সে সময় ধ্রুবের মন ধ্যানে নিশ্চল ছিল। ধ্রুব হৃদয়পদ্মে বিদ্যুৎ প্রভার ন্যায় শ্রীভগবানের রূপ দেখেছিলেন। শ্রীভগবান যখন ধ্রুবের হৃদয় মধ্য হতে অন্তঃস্থ রূপ আকর্ষণ করে নিলেন, তখন ধ্রুব সহসা সেই রূপের অবসান দেখে সমাধি ভঙ্গ করে উঠলে বাইরে তিনি সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীনারায়ণকে দর্শন করে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। ধ্রুব কিছু বলার অভিলাষী জেনে ভগবান বেদময় শঙ্খ দিয়ে তাঁর গণ্ডদেশ স্পর্শ করলে তিনি ঈশ্বর তত্ত্ব অবগত হয়ে সপ্রেমে স্তব আরম্ভ করলেন। শ্রীভগবান ধ্রুবকে বর দিয়ে আবার বলিলেন—"তোমার পিতা সম্প্রতি তোমাকে রাজ্যের শাসনভার দিয়ে বনে যাবেন, তুমি ছত্রিশ হাজার বৎসর পর্যন্ত রাজত্ব করবে। যজ্ঞই আমার প্রিয়, তুমি প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে যজ্ঞ দ্বারা আমার অর্চনা কর, তা হলে ইহলোকে রাজ্যভোগ করে অন্তিম কালে আমাকে স্মরণ করতে পারবে এবং আমার ধামে গমন করতে পারবে।" এ কথা বলে ভগবান গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ করে নিজ ধামে চলে গেলেন। ধ্রুবও সংকল্পিত মনোরথ লাভ করে পিতার রাজ্যে ফিরে গেলেন। এই মধুবন যারা দর্শন করেছেন, নাম শ্রবণ করেছেন, সেবা করেছেন ও মহিমা কীর্তন করেছেন পৃথিবীতে তারা ধন্য।

মহলী গ্রামঃ

ধ্রুবটীলার দক্ষিণ-পশ্চিমকোণে এই মহোলী গ্রাম অবস্থিত। পরিক্রমার যাত্রীগণ এই গ্রামে এক রাত্রি যাপন করেন। শ্রীভগবান এই বনে মধুদৈত্যকে বিনাশ করেছিলেন। সেই অবধি এই বনের নাম মধুবন বলে প্রসিদ্ধ লাভ করেছে।

শ্রীকৃষ্ণকুণ্ডঃ

মহলী গ্রামের মধ্যস্থলে গভীর জলপূর্ণ একটি স্বচ্ছ কুণ্ড আছে। শ্রীকৃষ্ণ গাভীদের জলপান করাবার জন্য এই কুণ্ডটি তৈরী করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজের বাঁশীর দ্বারা ভূমিতে আঘাত করে এই বৃহৎ কুণ্ড প্রকট করেন। এই জন্য এই কুণ্ডকে কৃষ্ণ কুণ্ড বলা হয়।

শ্রীবলরাম মন্দিরঃ

শ্রীকৃষ্ণকুণ্ডের উত্তর তীরে একটি মন্দিরে শ্রীবলরামের কালো রঙ্গের অপূর্ব সুন্দর শ্রীবিগ্রহ দর্শনীয়। ব্রজবাসীদের দ্বারা এই সুন্দর শ্রীবিগ্রহ অতি আদরের সহিত সেবিত হন। এই মন্দিরের সম্মুখ ভাগেই একটি গৌড়ীয় মঠ রয়েছে। মন্দিরের শ্রীবিগ্রহ গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের দ্বারা সেবিত হন।

শ্রীশত্রুঘ্ন মন্দিরঃ

শ্রীকৃষ্ণকুণ্ডের তীরে একটি ছোট মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্রের ভ্রাতা শ্রীশত্রুঘ্ন মহারাজের শ্রীবিগ্রহ ব্রজবাসী সেবকদের দ্বারা সেবিত হন। মন্দিরের শ্রীবিগ্রহ অপূর্ব সুন্দর দর্শনীয়।

শ্রীবল্লভাচার্যের বৈঠকঃ

পুষ্টিমার্গের আচার্য শ্রীবল্লভ ভট্টাচার্যের একটি বৈঠক রয়েছে। এই বৈঠকটি কৃষ্ণ কুণ্ডের দক্ষিণ তটে অবস্থিত। এই বৈঠকটি ব্রজবাসীদের দ্বারা সেবিত হয়। এই মধুবনে যারা দর্শনার্থে আগমন করেন তাদের অভীষ্ট অচিরেই সিদ্ধ হয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url