ভগবদ্গীতা উপলব্ধির জন্য অতি প্রয়োজনীয় কিছু সূত্র | আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)
ভগবদ্গীতা উপলব্ধির জন্য অতি প্রয়োজনীয় কিছু সূত্র
ভগবদ্গীতা পাঠ শুরু করার পূর্বে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি শিক্ষার্থীর স্মরণ রাখা কর্তব্যঃ
★ ভগবদ্গীতা বাস্তব সত্য, না প্রতীকি?
ভগবদগীতা হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের কথোপকথন যা প্রকৃতই ঐতিহাসিক । ভাবীকালের সকল মানুষের জন্য ঐ কথোপকথন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল । কুরুক্ষেত্র একটি ঐতিহাসিক স্থান, যা আজও বিদ্যমান । অর্জুন, যুধিষ্ঠির, ভীষ্ম, দুর্যোধন-এর মতো মহাভারতের সমস্ত চরিত্র বাস্তব, তারা সত্যিসত্যিই ছিলেন । এই ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করা, কিংবা এর মধ্যে কোনো রূপক অর্থ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা অত্যন্ত অসমীচীন ।
★ কিভাবে ভগবদ্গীতা উপলব্ধি করা উচিত?
ভগবদ্গীতাকে উপলব্ধি করতে হবে “যথাযথ” রূপে ('As It Is') । আমাদের দেশে ভগবদ্গীতার অসংখ্য সংকলন রয়েছে, যা কষ্টকল্পিত, বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যায় ভর্তি । গীতার এই সব সংকলকেরা ব্যাখ্যা করেনঃ “সম্ভবতঃ কৃষ্ণ এই উক্তির দ্বারা এটাই বোঝাতে চেয়েছেন” - এইভাবে তাঁরা জল্পনা-কল্পনা করতে থাকেন । পরম সত্য সম্বন্ধে কোনো মানসিক জল্পনার প্রয়োজন নেই । পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা রিসার্চ-এর অর্থই হচ্ছে হারানো কোন কিছুকে নির্ধারণের প্রয়াস ।
কিন্তু শাস্ত্র যখন পরম সত্যকে উপস্থাপন করে, তখন সরাসরি গ্রহণ করার পরিবর্তে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, গবেষণা করা বা তাকে বিকৃত করার প্রয়োজন কোথায়? আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে শাস্ত্রের প্রত্যক্ষ অর্থকে গ্রহণ করা এবং তাকে কার্যে রূপায়িত করা। আমাদের এভাবে পড়া উচিত নয়, “ভগবদ্গীতা : যেমন আমি এটিকে দেখতে চাই”,কিংবা, “ভগবদ্গীতা : যেমন এটি হওয়া উচিত"। আমাদের পড়া উচিত - “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : যথাযথ (As it Is), যা আমাদেরকে ভগবদগীতার প্রত্যক্ষ অর্থ প্রদান করে - ঠিক শ্রীকৃষ্ণ যেমন বলেছিলেন, কোনো রকম বিকৃতি বা অপব্যাখ্যা ছাড়াই । আর এটা ব্যবহারিকভাবেই প্রমাণিত সত্য যে পরম্পরা ধারা-ক্রমে আগত এই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ মানুষের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে পারে, তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত পাপময় কার্যকলাপ থেকে বিমুক্ত করে তাদের জীবনকে নির্মল পবিত্র করতে পারে ।
★ ভগবদ্গীতার লক্ষ্য-শ্রীকৃষ্ণঃ
ভগবদ্গীতার বিষয়, মুখ্য প্রতিপাদ্য এবং লক্ষ্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ । ভগবদ্গীতার অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হলেও সেগুলি যে মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি, তার কারণ হচ্ছে এই সমস্ত সংস্করণে কৃষ্ণ-অর্জুনকে দূরে সরিয়ে রেখে বা তাদের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে ভাষ্যকারেরা তাদের নিজেদের স্বকল্পিত বা স্বমত-দুষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন । তাদের ঐ সব সিদ্ধান্ত আদৌ গীতার বাণী নয়, তা তাদের আপন মানস-সৃষ্টি । গীতা যেহেতু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী সেজন্য শ্রীকৃষ্ণের অভিপ্রায়কে গুরুত্ব না দিয়ে কখনই ভগবদ্গীতাকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় ।
★ শ্রীকৃষ্ণ- ভগবদ্গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্যঃ
পরমপুরুষ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একজন যোগী পুরুষ, বিদ্বান বা বলশালী ব্যক্তি-মাত্র নন । ভগবান কোনো সাধারণ বা এমনকি অসাধারণ কোনো মানবও নন। তিনি পরমপুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং। ভগবদ্গীতা যে সারা বিশ্বে অত্যন্ত সমাদৃত তার কারণ এটি শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ-নিঃসৃত, আর শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান। অর্জুনের মতো ভগবদ্ভক্তই কেবল ভগবদ্গীতা উপলব্ধি করতে পারেন। ভগবদ্গীতা উপলব্ধির জন্য অন্ততঃ তাত্ত্বিকভাবেও স্বীকার করতে হবে যে শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান । সুতরাং ভক্তিপূর্ণ মনোভাব নিয়ে ভগবদ্গীতাকে গ্রহণ করা উচিত ।
★ আজকের দিনে ভগবদ্গীতার প্রাসংগিকতাঃ
ভগবদ্গীতা কখনই পুরানো হয়ে যায় না, কেননা এটি সর্ব-স্থানে, সর্ব কালে, সর্ব পরিস্থিতিতে সর্বদাই ফলপ্রসূ, প্রাসঙ্গিক । আপেক্ষিক জ্ঞান (যেমন পদার্থ বা রসায়নবিদ্যা) পুরানো বা পরিবর্তনযোগ্য হয়ে থাকে । বিজ্ঞানীরা তাদের ত্রুটিপূর্ণ আপেক্ষিক সত্যকে পরাভূত করে তার থেকে উন্নততর কোনো ত্রুটিপূর্ণ আপেক্ষিক সত্যের অবতারণা করে চলেছেন । পক্ষান্তরে ভগবদ্গীতা উপস্থাপন করছেন পরম জ্ঞান (Absolute Knowledge), যা প্রদত্ত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা - যিনি হচ্ছেন পরম পুরুষ (Absolute Person), এবং পরমেশ্বর ভগবান (The Supreme Personality), যাঁর ইন্দ্রিয়গুলি সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিহীন, পূর্ণ। তিনি আজ থেকে ১২ কোটি বছর পূর্বে এই একই জ্ঞান পৃথিবীতে প্রদান করেছিলেন। সেই একই জ্ঞান কোনোরূপ বিকৃতি বা পরিবর্তন ছাড়াই আজও বিদ্যমান । সুতরাং ভগবদ্গীতার জ্ঞান হচ্ছে ‘রাজবিদ্যা', সকল জ্ঞানের রাজা। এই জ্ঞান পরম, অভ্রান্ত, শাশ্বত; স্থান, কালের পরিধির অতীত।
★ ভগবদ্গীতা - একটি বিজ্ঞানঃ
ভগবদ্গীতা একটি বিজ্ঞান। প্রকৃত ধর্ম একটি বিজ্ঞান বিশেষ । ভগবদ্গীতায় প্রদত্ত জ্ঞান পরীক্ষাযোগ্য; সেকথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তিতে প্রতিপন্ন হয়েছে; ‘প্রত্যক্ষাবগমং ধর্ম্যং (ভ. গী. ৯/২)। কোন ধর্মের যদি দার্শনিক ভিত্তি না থাকে, তবে তা ভাবপ্রবণতা (Sentimentalism) ছাড়া আর কিছুই নয়। আর ধর্ম (ধর্মীয় ভিত্তি) ছাড়া যে কোন দৰ্শন কেবল মানসিক জল্পনা-কল্পনা-মাত্র । ভগবদ্গীতা প্রকৃত ধর্ম ও যথার্থ দর্শনের বিজ্ঞানসম্মত উপস্থাপনা।
★ ভগবানের বাণী ভগবানের মতই মঙ্গলপ্রদঃ
ভগবানের বাণীর সাথে স্বয়ং ভগবানের কোনো পার্থক্য নেই। সেজন্য অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে, নিজ জীবনের পরম পূর্ণতা-সাধনের লক্ষ্য নিয়ে ভগবদ্গীতার অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ গ্রহণ করা উচিত । যদিও শ্রীকৃষ্ণ সেইভাবে এখন আমাদের সামনে উপস্থিত নেই - যেমন ভাবে তিনি অর্জুনের সামনে ছিলেন, তবু তাঁর শ্রীমুখনিঃসৃত “বাণী” বা উপদেশ আজও অবিকৃতভাবে বর্তমান । যিনিই প্রগাঢ় আন্তরিকতার সাথে ভগবৎ-প্রদত্ত বাণী অনুধাবনে প্রবৃত্ত হবেন, ভগবান তাঁর সঙ্গে অনুরূপভাবেই আদানপ্রদান করবেন ।
★ ভগবদ্গীতাঃ যুদ্ধক্ষেত্রে কেন কথিত হয়েছিল?
ভগবদ্গীতার জ্ঞান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রদত্ত হয়েছিল - এটি তাৎপর্যবহ । যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধের মতো আমাদের জীবনও যেন এক মহাযুদ্ধ, মহাসংগ্রাম । রণভূমিতে অর্জুনের মতোই জীবন-যুদ্ধে আমাদের উত্তীর্ণ হওয়া অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার যারা জীবন-সংগ্রামে প্রকৃতই জয়ী হতে অভিলাষী, ভগবদ্গীতা তাদের জন্য । ভগবদ্গীতা আমাদের সকলের জন্য, অজ্ঞানতা থেকে আমাদের মুক্ত করার জন্য প্রদান করা হয়েছে।
সুত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ত্ব
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ(ইস্কন)