পারণ কী? পারণ কেন করতে হয়? রাত্রিতে কি পারণ নিষিদ্ধ?
পারণ কী? পারণ কেন করতে হয়? রাত্রিতে কি পারণ নিষিদ্ধ?
পারণ কী?
পারণ সম্পর্কে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড ৮.৫৬-৫৭) বলা হয়েছে-পারণং পাবনং পুংসাং সৰ্ব্বপাপপ্ৰনাশনম্॥
উপবাসাঙ্গভূতঞ্চ ফলদং শুদ্ধিকারণম্ ॥
অর্থাৎ, "পারণ অতি পবিত্র এবং মানুষের সর্বপাপনাশক। পারণ-উপবাসের অঙ্গস্বরূপ শুভফলপ্রদ ও শুদ্ধির কারণ।"
ব্রত, উপবাস শব্দগুলোর সঙ্গে প্রায় সকলেই পরিচিত। কিন্তু ব্রত-উপবাসের অঙ্গস্বরূপ পারণের কথা কিছু লোক হয়ত কোনো দিনই শোনেননি। সে যা হোক, সংস্কৃত 'পারণম্' (পারণ) বা 'পারণা' শব্দের আভিধানিক অর্থ ব্রতান্তে তথা উপবাসের পর ভোজন।
অর্থাৎ, পারণ হচ্ছে উপবাসের পর নির্দিষ্ট সময়ে ভোজনের মধ্য দিয়ে ব্রত সমাপ্তকরণ।
পারণ কেন করতে হয়?
কারো প্রশ্ন হতে পারে যে, উপবাসের পর পারণ কেন করতে হবে। এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বলা হলো যে, পারণ ব্রতের অঙ্গ বা অংশস্বরূপ। কেননা, ব্রতের প্রারম্ভেই সংকল্প করা হয় যে, "এই উদ্দেশ্যে এতটুকু সময় আমি উপবাস থাকব এবং এ সময়ের পর আমি ব্রত সমাপ্ত করব।" অর্থাৎ, নির্দিষ্ট সময়ে ব্রত সমাপ্ত করাটাও ব্রতের অংশ। সুতরাং, যদি পারণ না করা হয়, তার অর্থ সেই ব্রত অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ—
দোষ দ্বাদশ্যাং যৎ অপারণে (ভা. ৯.৪.৩৯)
আর যে ব্রত পূর্ণই হয়নি বা দোষযুক্ত, তার সুফল আমরা কীভাবে আশা করতে পারি? তাই উপবাসের পর নির্ধারিত সময়ে পারণ অবশ্যই কর্তব্য।
শ্রীমদ্ভাগবতে (ভা. ৯.৪.৩৮-৪০) আমরা দেখতে পাই,
মুহূর্তার্ধাবশিষ্টায়াং দ্বাদশ্যাং পারণং প্রতি।
চিন্তয়ামাস ধৰ্মজ্ঞো দ্বিজৈস্তদ্ধর্মসঙ্কটে ॥৩৮॥
ব্রাহ্মণাতিক্রমে দোষো দ্বাদশ্যাং যদপারণে।
যৎ কৃত্বা সাধু মে ভূয়াদধর্মো বা ন মাং স্পৃশেৎ ॥৩৯৷৷
অম্ভসা কেবলেনাথ করিষ্যে ব্রতপারণম্।
আহুরব্ভক্ষণং বিপ্ৰা হ্যশিতং নাশিতং চ তৎ ॥৪০॥
একাদশীর পরদিন মহারাজ অম্বরীষের গৃহে যখন দুর্বাসা মুনি আতিথ্য অঙ্গীকার করে মধ্যাহ্নকালীন
বিধি অনুষ্ঠান করার জন্য যমুনা নদীতে গমন করেছিলেন, তখন যমুনা থেকে তাঁর ফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে মহারাজ অম্বরীষ দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন। দ্বাদশীতে পারণের সময় যখন মাত্র অর্ধ মুহূর্ত বাকি ছিল অর্থাৎ, তৎক্ষণাৎ উপবাস ভঙ্গ করা আবশ্যক হয়েছিল, তখন তিনি ভাবছিলেন, যদি ব্রাহ্মণ রেখে পারণ করেন, তাহলে তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাবশত মহা অপরাধ হবে। আবার, যদি নির্ধারিত সময়ের ভেতর পারণ না করেন, তাহলে একাদশী ব্রত সম্পূর্ণ হবে না। তখন তিনি শাস্ত্রসিদ্ধান্ত অনুসারে, জলপান করা ভক্ষণ এবং অভক্ষণ উভয়ই— এরূপ বিবেচনাপূর্বক জলপান করে উপবাস ভঙ্গ তথা পারণ করেছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবতের (৯.৪.৩৯-৪০) তাৎপর্যে শ্রীল প্রভুপাদ লিখেছেন—"বেদে বলা হয়েছে, অপোহশ্নাতি তন্নৈবাশিতং নৈবানসিশতম্ । এই বৈদিক নির্দেশ ঘোষণা করে যে, জলপান করা ভক্ষণ এবং অভক্ষণ উভয়ই । কখনো কখনো আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা যখন সত্যাগ্রহ পালন করে অনশন করে, তখন তারা কিন্তু জলপান করে। জলপান করলে ভক্ষণ করা হবে না বলে বিবেচনা করে, মহারাজ অম্বরীষ কেবল একটু জলপান করতে মনস্থ করেছিলেন।"
রাত্রিতে পারণ নিষিদ্ধ
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের (কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৮.৫৭-৬০) নারায়ণ-নারদ সংলাপে নারায়ণবাক্য-
সৰ্ব্বেস্বেবোপবাসেষু দিবাপারণমিষ্যতে ॥৫৭॥
অন্যথা ফলহানিঃ স্যাদ্ ব্রতধারণপারণম্ ॥৫৮৷
নরাত্রৌ পারণং কুর্যা-দৃতে বৈ রোহিণীব্রতাৎ॥৫৯॥
পূর্বাহ্ণে পারণং শন্তং কৃত্বা বিপ্রসুরাৰ্চ্চনম্ ॥৬০॥
"মুনিগণের সকল উপবাসেই দিবা-পারণ অভিমত; তার অন্যথারূপে ব্রত ধারণ ও পারণ করলে ফলহানি হয়। রোহিণীব্রত ছাড়া অন্যান্য ব্রতে কখনো রাত্রিতে পারণ করবে না । হে বিপ্র, পূর্বাহ্নে (সকালে) দেবতাদিগের অর্চনা করে পারণ করাই প্রশস্ত এবং সর্বসম্মত।"
এ কারণেই শ্রীনৃসিংহ চতুর্দশী, শ্রীগৌরপূর্ণিমাদি উপবাসে শ্রীবিগ্রহের বিশেষ অৰ্চন বা অভিষেকের পর অসমর্থপক্ষে ফলমূলাদি অনুকল্প প্রসাদ গ্রহণ করা হয় এবং পরদিন সকালে পারণ করা হয়।