জন্মাষ্টমী-উপবাস-দিন নির্ণয় প্রসঙ্গ ও জন্মাষ্টমী-পারণকাল নির্ণয়
ব্রহ্মবৈর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ড—২৭.১১) একাদশী ব্রত না করার ফলস্বরূপ চতুর্দশ ইন্দ্র পর্যন্ত নরক-যন্ত্রণা ভোগের কথা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে যে-
জন্মাষ্টমীদিনে চৈব শ্রীরামনবমীদিনে।
শিবরাত্রৌ চ যো ভুঙেক্ত সোহপি দ্বিগুণপাতকী ॥
"এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী, রামনবমী ও শিবরাত্রি দিবসে যিনি ভোজন করেন তথা উপবাস না করেন, তিনি তা অপেক্ষা দ্বিগুণতর পাতকী হন।" তবে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একাদশী ছাড়াও জন্মাষ্টমী, রামনবমী, বামন দ্বাদশী ও নৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত পালনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এগুলোর ক্ষেত্রেও বিদ্ধা-অবিদ্ধা বিচারপূর্বক শুদ্ধা তিথিতে উপবাস কর্তব্য, কেননা-"উপবাসযোগ্য তিথি ব্যতীত কেবল নক্ষত্রযোগে শুভ ফল দান করে না- এটি মুনিগণ কীর্তন করেছেন। "জন্মাষ্টমী ব্রত যদিও সকলেরই করণীয়, তথাপি অজ্ঞতাবশত কেউ কেউ তা অবজ্ঞা করে। তাদের জন্য ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (কৃষ্ণজন্মখণ্ড—৮.৭৬-৭৮) বলা হয়েছে—
শ্রীকৃষ্ণজন্মদিবসে যশ্চ ভুঙেক্ত নরাধমঃ।
স ভবেন্মাতৃগামী চ ব্রহ্মহত্যাশতং লভেৎ৷৷
কোটিজন্মার্জিতং পুণ্যং তস্য নশ্যতি নিশ্চিতম্।
অনৰ্হশ্চশুচিঃ শশ্বদদৈবে পত্রে চ কৰ্ম্মণি৷।
অন্তে বসেৎ কালসূত্রে যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ ।
কৃমিভিঃ শূলতুল্যৈশ্চ তীক্ষ্ণদংষ্ট্ৰৈশ্চ ভক্ষিতঃ ॥
অর্থাৎ, "যে নরাধম শ্রীকৃষ্ণের-জন্মদিবসে (তথা আবির্ভাব তিথি) ভোজন করে, সে-ই মাতৃগমন ও শত ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপে লিপ্ত হয়। তার কোটিজন্মার্জিত পুণ্য নিশ্চয়ই নষ্ট হয় ও সে দৈব-পিতৃ-কার্যে সর্বদা অনধিকারী ও অশুচি থাকে এবং অন্তে সূর্য-চন্দ্রের অবস্থিতি কাল পর্যন্ত শূলতুল্য তীক্ষ্ণদন্তবিশিষ্ট কৃমিকীটের দ্বারা ভক্ষিত হয়ে কালসূত্রনামক নরকে বাস করে।"
পক্ষান্তরে, "শুদ্ধ জন্মাষ্টমীতে জাগরণ ও ব্রত করলে শতজন্মার্জিত পাপ হতেও মুক্তি লাভ হয়; তাতে সংশয় নেই। মানব যদি শুদ্ধা জন্মাষ্টমীতে জাগরণ ব্যতীত কেবল উপবাস করে, তাহলেও তার অশ্বমেধের ফল লাভ হয়। সে ব্যক্তি বাল্য, কৌমার, যৌবন অথবা বার্ধক্য সকল সময়ে সপ্তজন্মকৃত পাপ হতে যে মুক্তি লাভ করবে, তাতে সংশয় নেই।" (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৮.৭৩-৭৫)
জন্মাষ্টমীব্রতদিন-নির্ণয় প্রসঙ্গে শ্রীহরিভক্তিবিলাসে (১৫.৩২৮) বলা হয়েছে-
কৃষ্ণোপাস্যাষ্টমী ভাদ্রে রোহিণ্যাঢ্যা মহাফলা।
নিশীথেহত্ৰাপি কিঞ্চেন্দৌ জ্ঞে বাপি নবমীযুতা ॥
"ভাদ্রমাসে কৃষ্ণাষ্টমী উপবাসযোগ্যা, রোহিণী নক্ষত্রযুক্তা হলে মহাফলপ্রদা, মধ্যরাত্রে রোহিণীযুক্ত অষ্টমী হলে আরো অধিক ফলপ্রদা, তা সোম বা বুধবারযুক্তা হলে আরো অধিক প্রশস্তা এবং তা হতেও নবমী তিথিযুক্তা হলে অধিক ফলপ্রদা হয়।"এছাড়া, হরিভক্তিবিলাস (১৫/৩৫২) ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (কৃষ্ণজন্মখণ্ড ৮.৬২-৬৩) বর্ণিত আছে-
উদয়ে চাষ্টমী কিঞ্চিন্নবমী সকলা যদি ।
ভবতে বুধসংযুক্তা প্রাজ্পত্যর্ক্ষসংযুতা।
অপি বর্ষশতেনাপি লভ্যতে বা ন বা বিভো ॥
"সূর্যোদয়কালে কিঞ্চিৎমাত্র অষ্টমী থেকে সমস্ত দিনরাত্র নবমী হলে এবং তাতে বুধবার ও রোহিণী নক্ষত্রের যোগ হলে, তাকে অতি দুর্লভ জানতে হবে। হে বিভো, এরূপ যোগ শত বৎসরেও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ।"
ইন্দুঃ পূৰ্ব্বেহহনি জ্ঞে বা পরে চেদ্রোহিণীযুতা।
কেবলা চাষ্টমী বৃদ্ধা সোপোষ্যা নবমীযুতা ॥
(হ.ভ.বি. ১৫/৩৫৪)
পূর্বদিন সোম অথবা বুধবার, পরদিন যদি রোহিণীযুক্তা হয় এবং কেবলা অষ্টমী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে নবমীযুক্তা হয়, তবে পরদিন সেই নবমীযুক্তা অষ্টমীই উপবাসযোগ্যা। কিন্তু পূর্ব ও পর উভয় দিন যদি শুদ্ধা অষ্টমীর সাথে রোহিণী নক্ষত্রের যোগ থাকে, তাহলে যেদিন মধ্যরাত্রিতে রোহিণী থাকবে, সেদিন উপবাস হবে। আর যদি উভয় দিনে মধ্যরাত্রিতে রোহিণী নক্ষত্র থাকে, তাহলে পূর্বদিন উপবাস হবে।
জন্মাষ্টমী-পারণকাল নির্ণয়
জন্মাষ্টমী ব্রতের পারণ প্রসঙ্গে শ্রীহরিভক্তিবিলাসে (১৫/৩৯৭, ৪০১) বলা হয়েছে-
শুদ্ধায়াঃ কেবলায়াশ্চাষ্টমীবৃদ্ধৌ তু পারণম্।
তিথ্যন্তে ভেহধিকে ভান্তে দ্বিবৃদ্ধৌ চৈকভেদতঃ॥৩৯৭
শুদ্ধা অর্থাৎ, সপ্তমীবেধবিহীন এবং কেবলা অর্থাৎ, রোহিণীনক্ষত্র যোগ ব্যতীত জন্মাষ্টমী ব্রতে পরদিন পূর্বাহ্নে অষ্টমী তিথি বৃদ্ধি পেলে তিথির অন্তে পারণ, নক্ষত্র সহিত ব্রতে নক্ষত্র অধিক থাকলে নক্ষত্রান্তে পারণ, তিথি ও নক্ষত্র উভয় বৃদ্ধি থাকলে যেকোনো একটির অন্তে পারণ।
যদ্বা তিথ্ব্যক্ষয়োরেব দ্বয়োরন্তে তু পারণম্।
সমর্থানামশক্তানাং দ্বয়োরেকবিয়োগতঃ ॥৪০১
"সমর্থ ব্যক্তিগণের পক্ষে তিথি ও নক্ষত্রান্তে পারণ, অশক্ত ব্যক্তিগণের পক্ষে যেকোনো একটির অন্তে পারণ ।" শ্রীহরিভক্তিবিলাস, ১৫ অধ্যায়ে (৩৯৭-৪০০) টীকায়* শ্রীল সনাতন গোস্বামী লিখেছেন- "শুদ্ধা (সপ্তমীবেধর্জিতা) ও কেবলা (রোহিণী ব্যতীত) অষ্টমী বৃদ্ধি পেয়ে পরদিন থাকলে অষ্টমীর অবসানে পারণ করা কর্তব্য। কেবল নক্ষত্র বৃদ্ধি পেয়ে পরদিন থাকলে রোহিণী নক্ষত্রের অন্তে পারণ করতে হয়। তিথি ও নক্ষত্র উভয়ই বৃদ্ধি পেয়ে পরদিন থাকলে ঐ উভয়ের মধ্যে একটির অবসানে পারণ করতে হবে। কিন্তু ঐ উভয় সমপরিমাণ হলে উভয়ের অন্তেই পারণ কর্তব্য। অগ্নি পুরাণে লিখিত আছে, হে ভরত, নক্ষত্রের অবসানে বা তিথির অবসানেই পারণ করার ব্যবস্থা। আরো লিখিত আছে, সুধীগণ রোহিণী-সমন্বিত অষ্টমীতে উপবাস করে থাকেন, বেদবিদ মুনিগণ রোহিণীর অন্তে পারণ করেন এবং তিথি ও নক্ষত্রের যোগে ব্রত হলে একটির অন্তে পারণ করতে হয়, বেদবিদগণ এই প্রকারই বিদিত আছেন অথবা তিথি ও নক্ষত্র এই উভয়ের অন্তে পারণ করা উপবাসক্ষম ব্যক্তির
পক্ষেই কর্তব্য। কিন্তু যেসকল ব্যক্তি অক্ষম, তিথি ও নক্ষত্রের একটির অন্তে তারা পারণ করতে পারেন।" এছাড়া উৎসবান্তে পারণের বিধানও শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, যা পরে আলোচনা করা হবে।
টীকা: শুদ্ধায়াঃ সপ্তমীবেধরহিতায়াঃ কেবলায়াঃ একাকিন্যাঃ রোহিণীং বিনাভূতায়া ইত্যর্থ। বৃদ্ধৌ
সত্যাং তিথেরষ্টম্যা অন্তে বিচ্ছেদে সতি পারণম্, ভে চ রোহিণীনক্ষত্রে কেবলে অধিকে বৃদ্ধে সতি
তস্য রোহিণীনক্ষত্রস্যান্তে পারণম্। দ্বয়োশ্চ তিথিনক্ষত্রয়োবৃদ্ধৌ সত্যামেকস্য তয়োর্মধ্যে তিথে
নক্ষত্রস্য বা কস্যচিদ্ভেদতশ্ছেদে সতি পারণং কার্য্যমিত্যর্থঃ। পূৰ্ব্বন্ধ 'তিথিভান্তে চ পারণম্' ইতি
যল্লিখিতং, তচ্চ দ্বয়োরের সাম্যেন বৃদ্ধ্যভিপ্রায়েণ, কিংবা অগ্রে লেখ্যপক্ষাপলন্তরাদরেণেতি জ্ঞেয়ম৷
‘সাংযৌগিকে ব্রতে' ইত্যনেন সংযোগস্যাপেক্ষয়া অষ্টম্যাং সংযোগাভাবে রোহিণ্যামপি পারণং
কাৰ্য্যমেব ॥ হ.ভবি ১৫.৩৯৭-৪০০