বিদ্ধা একাদশী বর্জন প্রসঙ্গে শাস্ত্রীয় প্রমাণ | বিস্তারিত জানুন

বিদ্ধা একাদশী বর্জন প্রসঙ্গে শাস্ত্রীয় প্রমাণ

এ প্রসঙ্গে শ্রীহরিভক্তিবিলাসধৃত গরুড়পুরাণ ও শিবরহস্যে বলা হয়েছে-

উদয়াৎ প্রাক্ যদা বিপ্র মুহূর্ত্তদ্বয়সংযুতা ।
সম্পূর্ণৈকাদশী নাম তত্ৰৈবোপবসেদ্গৃহী ॥
(হ.ভ.বি. ১২/৩১৬)
হে বিপ্র, সূর্যোদয়ের পূর্বে দুই মুহূর্ত (৪৮ x ২ = ৯৬ মিনিট অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট) ব্যাপী একাদশী থাকলে, তাকে সম্পূর্ণা একাদশী বলে। এ দিনেই উপবাস করা বিধেয়।
গরুড়পুরাণে বলা হয়েছে (পূর্বখণ্ড ১২৩/১৩) -
দশম্যেকাদশী যত্র তত্রস্থাশ্চাসুরাদয়ঃ
"যে দিনে দশমী ও একাদশী সংযুক্ত হয়, সেদিন উপবাস করলে আসুরিক উপবাস হয়; অতএব, দশমীযুক্ত একাদশীতে উপবাস কর্তব্য নয়।"
একাদশী কলাপি স্যাদুপোষ্যা দ্বাদশী তদা ॥৫॥
একাদশী দ্বাদশী চ বিশেষেণ ত্রয়োদশী।
ত্রিমিশ্রা সা তিথির্গ্রাহ্যা সর্ব্বপাপহরা শুভা ॥৬॥
একাদশীমুপোষ্যৈব দ্বাদশীমথবা দ্বিজ ।
ত্ৰিমিশ্ৰাঞ্চৈব কুর্ব্বীত ন দশম্যা যুতাং ক্বচিৎ ॥৭॥
(গরুড়পুরাণ, পূর্বখণ্ড ১২৫/৫-৭)
"যদি দ্বাদশী দিনে এক কলা মাত্র একাদশীও থাকে, তবুও দ্বাদশী দিনেই উপবাস করা কর্তব্য। যেদিন একাদশী, দ্বাদশী ও ত্রয়োদশী এই তিথিত্রয়ের মিশ্রণ হয়, সে দিনে উপবাস করলে সর্বপ্রকার পাপ নাশ হয়। যেদিন শুদ্ধা একাদশী থাকে, সে দিনেই উপবাস করা কর্তব্য, কিংবা দ্বাদশীযুক্ত একাদশীতেও উপবাস করতে পারে; অথবা যদি একদিন একাদশী, দ্বাদশী ও ত্রয়োদশী এই তিথিত্রয়ের মিলন হয়, তবে উপবাস করবে, কিন্তু, কখনো দশমীযুক্তা একাদশীতে উপবাস করবে না।"
বিদ্ধা একাদশী
ভবিষ্যপুরাণে (হরিভক্তিবিরাসধৃত ১২/৩১৯) বলা হয়েছে-
অরুণোদয়বেলায়ং দশমী-সংযুতা যদি ।
অত্রপোষ্যা দ্বাদশী স্যাৎ ত্রয়োদশ্যান্তু পারণম্ ॥
"যদি অরুণোদয় বেলাতে দশমী সংযুক্ত থাকে, এ স্থলে দ্বাদশী উপবাসযোগ্য হয় এবং ত্রয়োদশীতে পারণ।"
ভবিষ্যপুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে (হ.ভ.বি. ১২/৩১৭-৩১৮) আরো বলা হয়েছে-
আদিত্যোদয়বেলায়াঃ প্ৰাঙ্মুহূৰ্ত্তদ্বয়ান্বিতা।
একাদশী তু সম্পূর্ণা বিদ্ধান্যা পরিকীর্ত্তিতা ॥
অতএব পরিত্যাজ্যা সময়ে চারুণোদয়ে।
দশম্যৈকাদশী বিদ্ধা বৈষ্ণবেন বিশেষতঃ ॥
অর্থাৎ, "যদি সূর্যোদয়ের দুই মুহূর্ত অর্থাৎ, চারদণ্ড পূর্ব থেকে একাদশী আরম্ভ হয়, তাহলে ঐ একাদশীকে সম্পূর্ণা বলে। সূর্যোদয়ের পূর্বে চার দণ্ডের কম সময় একাদশী থাকলে বিদ্ধা বলে পরিগণিত হয়। অতএব, অরুণোদয়ের সময় দশমী বিদ্ধা বা দশমী সংযুক্ত একাদশী বর্জন করবে। বৈষ্ণবের পক্ষে দশমী সংযুক্ত একাদশী সর্বদা পরিত্যাজ্য।"
অরুণোদয়কালে তু দশমী যদি দৃশ্যতে ।
পাপমূলং তদা জ্ঞেয়মেকাদশ্যুপবাসিনাম্ ॥
(হ.ভ.বি.১২/৩৪৯)
"অরুণোদয়কালে যদি দশমী দৃষ্ট হয়, ঐদিন একাদশী উপবাসকারীগণের উপবাস পাপের কারণ বলে জানবে।"
Ekadashi
গর্গসংহিতা, মাধুর্যখণ্ডে (৮.৩২-৩৩)-
দশমী পঞ্চপঞ্চাশদ্ঘটিকা চেৎ প্রদৃশ্যতে ।
তৰ্হি চৈকাদশী ত্যাজ্যা দ্বাদশীং সমুপোষয়েৎ ॥৩২॥
দশমীপলমাত্রেণ ত্যাজ্যা চৈকাদশী তিথিঃ ।
মদিরাবিন্দুপাতেন ত্যাজ্যো গঙ্গাঘটো যথা ॥৩৩॥
"দশমী যদি পঞ্চান্ন দণ্ড হয়, তবে এর পরদিনের একাদশী ত্যাগ করে দ্বাদশীতে উপবাস করবে। এমনকি এক পল মাত্রও দশমীযুক্ত একাদশী মদিরাবিন্দুযুক্ত গঙ্গাজলের ঘটের ন্যায় পরিত্যাগ করবে।"
পদ্মপুরাণ, উত্তরখণ্ডে (২৩৪/১৭-১৮), (হ.ভ.বি. ১২/৩৩৪) -
অরুণোদয়বেলায়াং দশমীমিশ্রিতা ভবেৎ।
তাং ত্যক্ত্বা দ্বাদশীং শুদ্ধামুপোষ্যেদবিচারয়ন্ ॥
"অরুণোদয় বেলাতে যদি দশমী মিশ্রিত হয়, তা ত্যাগপূর্বক অন্য বিচার না করেই শুদ্ধা দ্বাদশীতে উপবাস করবে।"
অগ্নিপুরাণে (১৮৭/৪) এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
দশম্যাকাদশীমিশ্রা নোপোষ্যা নরকপ্রদা ॥
"দশমীমিশ্রা একাদশীতে কোনোমতেই উপবাস করবে না। তাতে নরক লাভ হয়।"
পদ্মপুরাণে স্বর্গখণ্ডে (৪৪.৬৩-৬৮) বলা হয়েছে-
প্রাণিভির্দশমীবিদ্ধা ন চোপোষ্যা কদাচন।
পরিহার্য্যং দ্বিজশ্রেষ্ঠ দুৰ্জ্জনস্যাপ্তিকং যথা ॥৬৩॥
অরুণোদয়বেলায়াং দশমী সঙ্গতা যদি ।
তত্রোপোষ্যা দ্বাদশী স্যান্ত্রয়োদশ্যান্তু পারণম্ ॥৬৪
দশমীশেষসংযুক্তো যদি স্যাদরুণোদয়ঃ ।
বৈষ্ণবেন ন কৰ্ত্তব্যং তদ্দিনৈকাদশীব্রতম্ ॥৬৫॥
চতস্রো ঘটিকাঃ প্রাতররুণোদয় উচ্যতে ।
যতীনাং স্নানকালোহয়ং গঙ্গাম্ভঃসদৃশ স্মৃতঃ ॥৬৬॥
অরুণোদয়কালে তু দশমী যদি দৃশ্যতে ।
ন তত্ৰৈকাদশী কাৰ্য্যা ধৰ্ম্মকামার্থনাশিনী ॥৬৭॥
স্বল্পাঞ্চ দশমীবিদ্ধাং ত্যজেদেকাদশীং বুধঃ ।
সুরাবিন্দুসুসম্পর্কাদৃঘৃতকুন্তং ত্যজেদ্ যথা ॥৬৮॥

"প্রাণিগণ কর্তৃক দশমীবিদ্ধা একাদশী কখনোই উপবাসযোগ্য নয়, দুর্জনসান্নিধ্যের ন্যায় তা সর্বথা পরিহার্য। অরুণোদয় বেলায় যদি দশমী সঙ্গতা হয়, তবে তখন দ্বাদশীতেই উপবাস হবে; ত্রয়োদশীতে পারণ করবে। যদি অরুণোদয়কাল দশমী শেষসংযুক্ত হয়, তবে সেদিন বৈষ্ণব কর্তৃক একাদশী ব্রত কর্তব্য নয়। প্রাতে চার দণ্ড কাল অরুণোদয় বলে উক্ত হয়, যতীদিগের এটাই স্নানকাল; তখন সমস্ত জলই গঙ্গাজল তুল্য । যদি অরুণোদয়কালে দশমী দৃষ্ট হয়, তবে সেদিন একাদশী করবে না; কারণ তা ধর্মকামার্থনাশিনী। সুরাবিন্দু সম্পর্কে যেমন ঘৃতকুণ্ডকে ত্যাগ করতে হয়, তদ্রূপ স্বল্পমাত্র দশমী দ্বারা বিদ্ধা একাদশীকেও বুদ্ধিমান ব্যক্তি বর্জন করবে।"
স্কন্দপুরাণে (বিষ্ণুখণ্ড, কার্তিকমাস মাহাত্ম্য ৩৩/৩৬-৩৭)
দশমীবেধসংযুক্তা ত্যাজ্যা চৈকাদশী ব্রতে।
গান্ধার্য্যাপি পুরা তস্যামুপবাসঃ কৃতো গুহ ॥৩৬৷
তস্যাঃ পুত্ৰশতং নষ্টং তস্মাত্তাং বেধজাং ত্যজেৎ॥৩৭৷

"পুরাকালে গান্ধারী দশমীযুক্তা একাদশীতে উপবাস করেছিলেন, এজন্য তাঁর শত তনয় নিহত হয়। অতএব, দশমীযুক্তা একাদশী পরিত্যাজ্য।" সুতরাং, একাদশী দিবসে অরুণোদয়কালে দশমী স্পর্শ হলে, তাকে দশমীবিদ্ধা একাদশী বলে। দশমীবিদ্ধা একাদশী বাদ দিয়ে দ্বাদশী সংযুক্তা একাদশী ব্রত পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে একাদশীতে অন্ন গ্রহণ করলে পাপ হয় না। কেননা, গরুড়পুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণাদি শাস্ত্রানুযায়ী এটাই বিধি । উপর্যুক্ত গ্রন্থসহ বিভিন্ন ঋষি এবং পুরাণ শাস্ত্রের বচন অনুসরণে এই সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবগণ কখনো অরুণোদয় বা দশমী বিদ্ধা একাদশী ব্রত পালন করেন না।

শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে (১২.৩৫১) শ্রীপাদ সনাতন গোস্বামী বলেছেন—
এবং জ্ঞেয়ানি বাক্যানি বিদ্ধাব্রতপরাণি তু।
অবৈষ্ণবাশ্রয়াণ্যেব শুক্রমায়া-কৃতানি বা ॥
"অরুণোদয়বিদ্ধা একাদশীতে উপবাস করা যায়- এভাবে যেসব বচন আছে, সেগুলো অবৈষ্ণবপর সকাম গৃহস্থদের জন্য বুঝতে হবে। যেহেতু, তাদেরও বিদ্ধা উপবাসে বহুদোষ শাস্ত্রে দেখা যায়, সুতরাং, সেসকল বাক্য শুক্রাচার্যকৃত অসুরমোহনার্থে রচিত বলে জানতে হবে।" অতএব, অরুণোদয়বিদ্ধা একাদশীতে উপবাস শুধু বৈষ্ণবগণেরই নয়, এমনকি কারোরই কখনো করা উচিত নয়। প্রচলিত পঞ্জিকাগুলোতে (যেগুলো মূলত স্মাৰ্তমত অনুযায়ী লেখা) দশমী বিদ্ধা হলেও একাদশীর ব্যবস্থা আছে এবং পাশাপাশি পরদিন বৈষ্ণবদের জন্য একাদশীর উপবাসের কথা উল্লেখ থাকে। এজন্য যারা স্মার্ত মতে বিশ্বাসী, তারা এই বিষয়ে আজও 'গোস্বামী মতে পরাহে' কথাটি উল্লেখ করে থাকেন। কখনো কখনো ইস্কন প্রকাশিত পঞ্জিকায় উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে বাইরের পঞ্জিকায় উল্লিখিত সময়ের অমিল দেখা যায়। সেক্ষেত্রে, প্রামাণিক উৎস হিসেবে ইস্কন অনুসারীগণ নির্দ্বিধায় ইস্কন প্রকাশিত পঞ্জিকা অনুযায়ীই ব্রত পালন করে থাকেন। তবে, উপবাস-দিন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ইস্কনের সঙ্গে অন্যান্য বৈষ্ণবসম্প্রদায়, এমনকি গৌড়ীয়দের মধ্যেও কদাচিৎ অমিল দেখা যায়। এর কারণ দিনপঞ্জির সময় নির্ধারণ। যেমন, কোনো জ্যোতিষীর হিসাবে একাদশী তিথি শুরু হলো ভোর ৩.৩০ থেকে, আবার, কারো হিসাবে তা শুরু হলো ৪.৩০ থেকে। এক্ষেত্রে কারো কাছে যে সম্প্রদায়কে প্রামাণিক উৎস বলে মনে হয়, তার সিদ্ধান্ত অনুসারে কেউ উপবাস করবে কি না, সে সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত। কারণ, তা সঠিকও হতে পারে, ভুলও হতে পারে; সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত। যেমন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনেক আছেন। কোনো রোগীর জন্য তাদের নির্ধারিত ঔষধ ভিন্ন হতে পারে। তখন যে ডাক্তারকে অধিক অভিজ্ঞ বা সঠিক বলে মনে হয়, তার কাছ থেকে কেউ চিকিৎসা নিতে পারে। একইভাবে, কারো কাছে যদি ইস্কনের চেয়ে অন্য কোনো সম্প্রদায়কে সঠিক ও প্রামাণিক বলে মনে হয়, তবে তিনি তার মতানুসারে উপবাস করবেন, এটাই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, ইস্কন একটি প্রামাণিক পরম্পরাভুক্ত, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপাপুষ্ট, আন্তর্জাতিক ও নির্ভরযোগ্য সংগঠন, যেখানে অত্যন্ত বিজ্ঞ জ্যোতিষী ও পণ্ডিতবর্গ কর্তৃক দিনপঞ্জির সময় নির্ধারণ করা হয়। তাই ইস্কন-অনুসারী ও অনুরাগীগণ ইস্কন জিবিসি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ানুসারে উপবাস করে থাকেন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url