উপবাস প্রকৃতপক্ষে কী? বিশেষ বিশেষ তিথিতে উপবাস কেন?
উপবাস প্রকৃতপক্ষে কী? বিশেষ বিশেষ তিথিতে উপবাস কেন?
সাধারণ অর্থে উপবাস বলতে বোঝায় অনাহারে থাকা। তবে, অগ্নিপুরাণে (১৫৭.৬) উপবাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ঃ সর্বভোগবিবর্জিতঃ।
অর্থাৎ, "সর্বপ্রকার ভোগ পরিত্যাগই উপবাস।"
ব্রতং হি কর্ত্তৃসন্তাপাৎ তপ ইত্যভিধীয়তে।
ইন্দ্রিয়গ্রামনিয়মানিয়মশ্চাভিধীয়তে ॥
(অগ্নিপুরাণ ১৫৭.৩)
"উপবাসাদি দ্বারা কর্তার সন্তাপ হয়, এজন্য ব্রতকে তপঃ বলে এবং ইন্দ্রিয়সমূহের নিয়মন বা সংযম করে, এইজন্য ব্রতের নাম নিয়ম।"
'উপ' অর্থ নিকটে এবং 'বাস' অর্থ অবস্থান করা। সুতরাং, উপবাস অর্থ আমাদের একাদশ ইন্দ্রিয়— ৫টি কর্মেন্দ্রিয় (হস্ত, পদ, উদর, পায়ু ও উপস্থ), ৫টি জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক) এবং মনকে সর্বগুণাকর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে সম্পূর্ণরূপে নিবদ্ধ করা। এভাবে ভগবানের নিকটে বাস করা। এ প্রসঙ্গে স্কন্দপুরাণে (বিষ্ণুখণ্ড, মার্গশীর্ষমাসমাহাত্ম্য, ১২/৩০) বলা হয়েছে-
উপবৃত্তস্তু পাপেভ্যো যস্তু বাসো গুণৈঃ সহ ।
উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ো ন শরীরস্য শোষণম্ ॥
"পাপবৃত্তি হতে নিবৃত্তি এবং গুণ সকলের সহিত বাস, একেই উপবাস বলে; কিন্তু কেবল শরীর শোষণ উপবাস নয়।" অগ্নিপুরাণেও (১৫৭.৫-৬) একথা বলা হয়েছে।
ভগবানের জন্য উপবাস এক প্রকার তপস্যা, যা হতে হয় কায়মনোবাক্যে। তাই উপবাসকালে অধিক মাত্রায় ভগবানের সেবা করার মাধ্যমে কায় (দেহ), অধিক সংখ্যক হরিনাম জপ ও হরিকথা কীর্তনের মাধ্যমে (বাক্য) এবং এভাবে নিরন্তর ভগবৎ-চিন্তার মাধ্যমে (মন) একাগ্র করে তপস্যা করতে হয়।
সুতরাং, উপবাসের অর্থ শুধু অনাহারে থাকা নয়। শুধু অনাহারে থেকে কীভাবে ভগবানকে সন্তুষ্ট করা যায়? মূল বিষয় হলো আহার, নিদ্রা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়তপণমূলক কাজে কম গুরুত্বারোপ করা, যাতে ভগবানের চরণে আমাদের মন নিবদ্ধ হতে পারে।
এমনকি জল পর্যন্ত না পান করে অর্থাৎ, নির্জলা উপবাস অপেক্ষা ভগবানের বাণী প্রচার বা সেবা যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে ৫ জুলাই, ১৯৭৫ সালে শিকাগোতে একটি প্রাতঃভ্রমণে শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ বলেন, একসময় তাঁর এক গুরুভ্রাতা মাধব মহারাজের (পূর্বাশ্রমে যাঁর নাম ছিল হয়গ্রীব) প্রচারের জন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্জলা উপবাস করে ক্লান্ত থাকার কারণে তিনি সেখানে যাননি। তখন তাঁর গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাঁর অন্য এক শিষ্যকে বলেছিলেন যে, "তাকে এখনই কিছু অনুকল্প প্রসাদ পেতে বলো এবং প্রচারে যেতে বলো।" তিনি এটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, ভগবানকে স্মরণ করা বা তাঁর সেবা করা অনাহারে থাকার চেয়েও কত গুরুত্বপূর্ণ! আবার, শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/১২/১-২) শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীল শ্রীধর স্বামীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, "ভগবদ্ভক্তের এমনভাবেবৈদিক রীতিনীতি নির্বাচন করা উচিত, যাতে ভগবানের উদ্দেশ্যে তাঁর সেবা নিবেদনের পদ্ধতিতে কোনো প্রকারে বিঘ্ন সাধন না হয়।" তাই শ্রীহরিভক্তিবিলাসধৃত (১২.৪০৯) বিষ্ণুরহস্যে বলা হয়েছে—
উপবাসনিষেধে তু কিঞ্চিদ্ভক্ষ্যং প্রকল্পয়েৎ।
নো দুষ্যত্যুপবাসোহত্ৰ উপবাসফলং লভেৎ ॥
"উপবাসে আহার গ্রহণ নিষেধের তাৎপর্য নিরম্বু (নির্জলা) উপবাস না, কিঞ্চিৎ ফল-মূলাদি অনুকল্প গ্রহণ করবে। এতে উপবাস দূষিত হয় না, উপবাসের ফল পাওয়া যায়।"
অতএব, আমরা যদি শুধু নিয়মের ওপর গুরুত্ব দিই, তাহলে না খেতে পেয়ে শরীরই অচল হয়ে পড়বে (যেহেতু এখনও আমরা দেহাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন) এবং তা ভগবৎসেবায় ব্যাঘাত ঘটাবে। তখন তা হবে নিয়মাগ্রহ। তবে, এ কথার সুযোগ নিয়ে কারো সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শাস্ত্র নির্দেশ অমান্য করা উচিত নয়। তাই আমাদের শাস্ত্র ও সদ্গুরু প্রদত্ত নিয়ম অনুসারেই উপবাস করতে হবে এবং তা অবশ্যই দৈহিক ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্য বজায় রেখে।
বিশেষ বিশেষ তিথিতে উপবাস কেন?
একাদশী, জন্মাষ্টমী আদি বিশেষ বিশেষ তিথিতে উপবাস নিয়ে আজকাল অনেকের আপত্তি দেখা যায়। যেমন, জন্মাষ্টমীর ক্ষেত্রে তারা বলেন, "আজ তো ভগবানের আবির্ভাব দিবস; কত আনন্দের বিষয়! আজ আরো অধিক ভোজন করব; উপবাস কেন?"
একাদশীতে উপবাসের একটি কারণ হলো সেদিন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর একাদশীদেবী রূপে আবির্ভাব তিথি। মহারাজ পরীক্ষিৎ অবিরত সাতদিন সাতরাত ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব ভুলে গিয়েছিলেন শুধু ভগবানের কথা শ্রবণ করেই। আর সেই ভগবান স্বয়ং যখন আবির্ভূত হন, তখন আনন্দের আতিশয্যে খাওয়ার কথা তো ভুলেই যাওয়ার কথা- শিশুরা খেলার আনন্দে মত্ত হয়ে যেমন খাওয়ার কথা ভুলে যায়। আহার ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য। সেই ভোগবাসনা পরিত্যাগ করে ভগবানের আবির্ভাবে ভক্তের মনোভাবটি থাকে এমন ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব ভুলে গিয়ে কী করে ভগবানের সেবা করা যায়, আরো অধিক সংখ্যক নাম জপ, তাঁর গুণমহিমা কীর্তন প্রভৃতি বিভিন্ন উপায়ে কীভাবে ভগবানকে সন্তুষ্ট করা যায়! বৈষ্ণবের আবির্ভাব-তিরোভাবের ক্ষেত্রেও তাই উপবাসপূর্বক তাঁদের মহিমা শ্রবণ-কীর্তনের মধ্য দিয়ে তাঁদের স্মরণ এবং কৃপা প্রার্থনা করা হয়।
স্কন্দপুরাণে (বিষ্ণুখণ্ড, মার্গশীর্ষমাসমাহাত্মম্ ১২.১৯) এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
বিষ্ণোঃ সম্প্রীণনার্থায়
"বিষ্ণুর প্রীতির জন্য একাদশী ব্রত উপদিষ্ট হয়েছে।"
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে (শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ৮/৫) ভগবান শ্রীনারায়ণ দেবর্ষি নারদকে বলছেন—
ব্রতোপবাসয়োর্ব্রহ্মন্ শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতুকম্ ৷৷
অর্থাৎ, "ব্রত-উপবাস কেবল শ্রীকৃষ্ণের প্রীতির নিমিত্ত।" সুতরাং, একাদশীতে উপবাসের উদ্দেশ্য হলো এরূপ তপস্যার দ্বারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করা এবং সেই সাথে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধান করা।
শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন (ভা. ৯.৪.২৯)- "একাদশী ব্রত এবং দ্বাদশীব্রত পালন করার উদ্দেশ্য ভগবানের প্রসন্নতাবিধান করা। যাঁরা কৃষ্ণভক্তিতে অগ্রসর হতে চান, তাঁদের অবশ্য কর্তব্য নিয়মিতভাবে একাদশীব্রত পালন করা।"
"যাঁরা কৃষ্ণভক্তির মার্গে উন্নতিসাধন করতে চান, তাঁদের পক্ষে অত্যধিক আহার করা উচিত নয়। ভগবদ্ভক্তরা বনে, পাহাড়ে অথবা পর্বতে তীর্থ করতে যেতেন,কিন্তু বর্তমান সময়ে এই প্রকার কঠোর তপস্যা করা সম্ভব নয়। তাই মানুষের কর্তব্য হচ্ছে কেবল ভগবৎ-প্রসাদ গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার না করা।
বৈষ্ণব দিনপঞ্জিতে একাদশী এবং ভগবান ও তাঁর ভক্তদের আবির্ভাব ও তিরোভাব তিথিতে উপবাস করার দিন রয়েছে। সেগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের মেদ হ্রাস করা, যাতে মানুষকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমাতে না হয় এবং তারা নিষ্ক্রিয় ও অলস না হয়ে যায়। অত্যাধিক আহার করলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘুমাতে হয়। এই মনুষ্য-জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে তপশ্চর্যা এবং তপশ্চর্যা মানে হচ্ছে যৌন জীবন, আহার ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা। এভাবে আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের জন্য সময় বাঁচানো যাবে এবং মানুষ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয়ভাবেই নিজেকে পবিত্র করতে পারবে। তার ফলে শরীর ও মন উভয়ই শুদ্ধ হতে পারবে।" (ভা. ৪.২৮.৩৫-৩৬ তাৎপর্য)
"একাদশী তিথিতে নিয়ন্ত্রিত উপবাস পালন করলে পারমার্থিক উন্নতির পক্ষে অন্তরায় হয় না। বরং, তা ভগবদ্ভক্তিমূলক সেবা অনুশীলনের পক্ষে নিত্যকালের বিষয় এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর ভক্তগণের পূজা-অর্চনার মূলনীতির সহায়করূপে পালনীয় বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেহেতু এ ধরনের গৌণ নিয়মনীতিগুলো মানুষকে তার প্রাথমিক ভগবদ্ভক্তি সেবা অনুশীলনের ব্রত সাধনে উপযুক্ত করে তুলতে সহায়তা করে থাকে, তাই সেগুলোও বিশেষভাবে কল্যাণকর। সুতরাং, ঐ সকল গৌণ রীতিনীতিগুলোও বৈদিক শাস্ত্রাদির মধ্যে ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সিদ্ধান্তস্বরূপ বলা চলে যে, ঐ ধরনের গৌণ নিয়মনীতিগুলো কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদনের অনুশীলনে বিশেষ অপরিহার্য এবং তাই ব্রতাদি পালন তথা শাস্ত্রে নির্ধারিত প্রতিজ্ঞা পালনের রীতিনীতি বর্জন করা কখনোই উচিত নয়।" (ভা. ১১/১২/১-২ তাৎপর্য)
শ্রীল রূপ গোস্বামীপাদকৃত শ্রীউপদেশামৃত (জিহ্বাবেগমুদরোপস্থবেগম্-১)-এর শিক্ষানুসারে প্রভুপাদ আরো বলেন, "দেহবেগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়- জিহ্বাবেগ, উদরবেগ ও উপস্থবেগ। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, এই তিনটি ইন্দ্রিয় দেহে একই সরলরেখায় অবস্থিত, আর দৈহিক বেগ বা দৈহিক তাড়নার শুরু হচ্ছে এই জিহ্বা থেকে। তাই জিহ্বাবেগ সংযত করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই উদর ও উপন্থবেগ জয় করা হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ার লালসা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তাই একাদশী, জন্মাষ্টমী ও অন্যান্য বৈষ্ণব-তিথিগুলোতে উপবাস করে আমরা উদরবেগ দমন করতে পারি ।" তখন উপস্থবেগ স্বাভাবিকভাবেই জয় করা যায়, যা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই বিশেষ বিশেষ তিথিতে উপবাস আবশ্যক।