হরিবাসরে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ-কীর্তনের মাহাত্ম্য
‘শ্রীমদ্ভাগবত’ ও ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা'- শব্দদুটি গুলিয়ে ফেলে অনেকেই দুটি ভিন্ন গ্রন্থকে এক বলে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা হলো সেই গ্রন্থ, যার জ্ঞান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাককালে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মহান ভক্ত ও সখা অর্জুন মহাশয়কে প্রদান করেছিলেন।
আর শ্রীমদ্ভাগবত হলো ব্রহ্মসূত্রের বিশদ ব্যাখ্যা, শ্রীল শুকদেব গোস্বামী ও মহারাজ পরীক্ষিতের মধ্যকার আলোচনা, যেখানে শ্রীনারদমুনি, প্রহ্লাদমহারাজ, ধ্রুবমহারাজ, বৃত্রাসুর প্রমুখ মহান ভগবদ্ভক্ত ও ভগবানের, বিশেষত পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাবিলাসের বর্ণনা কীর্তিত হয়েছে। বহুল তথ্য, ইতিহাস ও তত্ত্বজ্ঞানসমন্বিত এই শ্রীমদ্ভাগবত হলো সর্বোত্তম পুরাণ এবং সমগ্র বেদের নির্যাস ।
শ্রীমদ্ভাগবত ভগবানের শব্দরূপ অবতার তথা বাঙ্ময়বিগ্রহ, যাঁকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অমল পুরাণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা, অন্যান্য পুরাণসমূহ ত্রিগুণাত্মক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলোতে সকামকর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যাতে বিষয়কামী সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে পারমার্থিক স্তরে উন্নীত হতে পারে। কিন্তু জীবের সর্বোচ্চ স্থিতি হলো নিষ্কাম ও নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হয়ে কেবল পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টিবিধানের জন্যই কর্ম সম্পাদন করা; আর শ্রীমদ্ভাগবত সেই পরম শিক্ষাই প্রদান করে। সাধারণ লোকের নিকট সাত্ত্বিক পুরাণ বলে পরিচিত হলেও এই পুরাণ প্রকৃতপক্ষে নির্গুণ। তাই শ্রীমদ্ভাগবতকে বলা হয় ‘পরমহংস সংহিতা’; ত্রিগুণের বন্ধন থেকে মুক্ত পরমহংস এবং ভগবানের শুদ্ধভক্তগণ তাই নিবিষ্টচিত্তে শ্রীমদ্ভাগবত তথা ভগবৎকথা শ্রবণ ও কীর্তনকেই জীবনের পরম কর্তব্য বলে মনে করেন। কেউ যদি কেবল শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করেন, তাহলে তার আর অন্যকোনো পুরাণাদি পাঠের আবশ্যকতা নেই। একথা ব্রহ্মাকে ভগবান স্বয়ংই বলেছেন-
যঃ পঠেৎ প্রযতো নিত্যং শ্লোকং ভাগবতং সুত।
অষ্টাদশ পুরাণানাং ফলমাপ্নোতি মানবঃ ॥
(স্কন্দপুরাণ-বিষ্ণুখণ্ড-মার্গশীর্ষমাসমাহাত্ম্য ১৬.৩৩)
“হে পুত্র, যে মানব যত্ন সহকারে প্রতিদিন ভাগবতের একটি শ্লোকও পাঠ করে, তার অষ্টাদশ পুরাণ পাঠের ফল লাভ হয়।”
এই অমলপুরাণ শ্রীমদ্ভাগবত যদিও সকলের নিত্যপাঠ্য, তথাপি একাদশী আদি হরিবাসরে তা শ্রবণ বা পাঠ বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে শ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে (১৩.১৩১) পরমভাগবত শ্রীল সনাতন গোস্বামী লিখেছেন-
শ্রীমদ্ভাগবতং ভক্ত্যা পঠতে বিষ্ণুসন্নিধৌ।
জাগরে তৎপদং যাতি কুলবৃন্দসমন্বিতঃ ॥
“শ্রীহরিজাগরণে ভগবানের নিকট যিনি ভক্তিসহ শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ করেন,তিনি কুলবৃন্দসহ শ্রীভগবদ্ধামে গমন করেন।”
স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডে (মার্গশীর্ষমাসমাহাত্ম্য ১৬.৫৯-৬০) ভগবান ব্রহ্মাকে বলেন-
মমোৎসবেষু সৰ্ব্বেষু শ্রীমদ্ভাগবতং পরম্।
শৃণ্বন্তি যে নরা ভক্ত্যা মম প্ৰীত্যৈ চ সুব্রত ॥৫৯॥
বস্ত্রলিঙ্করণৈঃ পুষ্পৈর্ধূপদীপোপহারকৈঃ।
বশীকৃতো অহং তৈশ্চ সৎস্ক্রিয়া সৎপত্যিৰ্থা ॥৬০॥
“বস্ত্র, অলঙ্কার, পুষ্প, ধূপ, দীপ— এসকল উপহার প্রদানপূর্বক যে নর আমার যাবতীয় (তথা সমস্ত) উৎসবে আমার প্রীতির জন্য ভক্তিসহকারে পরম গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করে, পতিব্রতা পত্নী যেরূপ স্বামীকে বশীভূত করে, আমিও তদ্রূপ তার বশতাপন্ন হই।”
ন গচ্ছতি সদা মর্ত্ত্যঃ শ্রোতুং ভাগবতং সুত।
একাদশ্যাং বিশেষেণ নাস্তি পাপরতস্ততঃ ॥৪৯॥
শ্লোকং ভাগবতং চাপি শ্লোকাৰ্দ্ধং পাদমেব বা।
লিখিতং তিষ্ঠতে যস্য গৃহে তস্য বসাম্যহম্ ॥৫০
(স্কন্দপুরাণ-বিষ্ণুখণ্ড-মার্গশীর্ষমাসমাহাত্ম্য ১৬.৪৯-৫০)
হে তনয়, বিশেষত একাদশী দিনে যে মানব ভাগবত শুনতে গমন না করে, তা হতে পাপতর আর কেউই নাই, যার গৃহে ভাগবতের শ্লোকার্ধ বা শ্লোকপাদ লিখিত থাকে,আমি তার গৃহে বাস করি।
ঔত্তানপাদেশ্চরিতং ধ্রুবস্য চ মহাত্মনঃ ।
কৃষ্ণস্য বালচরিতং জাগরে পঠতে হি যঃ ।
যুগকোটিসহস্রস্য ক্ষয়ঃ পাপস্য জায়তে ॥
হ.ভ.বি. ১৩.১২৯
“যিনি শ্রীহরিবাসরীয় নিশিজাগরণে উত্তানপাদনন্দন মহাত্মা ধ্রুবের চরিত্র এবং শ্রীকৃষ্ণের বাল্যচরিত পাঠ করেন, তাঁর কোটি সহস্রযুগের জাত বা ভোগ্য পাপ ক্ষয় হয়।” উল্লেখ্য, শ্রীমদ্ভাগবতে মহাত্মা ধ্রুব এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাস চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে।
সুতরাং, পরমার্থ লাভে ইচ্ছুক প্রতিটি মানুষের উচিত শুধু একাদশী আদি হরিবাসরেই নয়, প্রতিদিনই এই শ্রীমদ্ভাগবত অধ্যয়ন করা।