প্রণাম বিধি-শাস্ত্রমতে প্রণামের প্রকারভেদ এবং কাকে,কিভাবে প্রণাম করা উচিত?

প্রণাম বিধি - শাস্ত্রমতে প্রণামের প্রকারভেদ এবং কাকে, কিভাবে প্রণাম করা উচিত?

প্রণাম - বৈদিক বিনম্রাতার বা আত্মসমর্পণের প্রতীক
ভারতীয় বৈদিক সভ্যতায় সবসময় বিনম্র হওয়াকে শেখানো হয়েছে। নিজের থেকে অন্যজনকে বড় করে দেখার বিষয়টা বৈষ্ণব সমাজে বেশ সমাদৃত। কেননা পরমেশ্বর ভগবান আমাদের দেহেই অবস্থান করেন পরমাত্মা রূপে। তাই আমরা একজনকে দেখলে নমস্কার(সম্মান সূচক অভিবাদন) বা প্রণাম করে থাকি।

প্রণাম সম্পর্কিত যা যা জানতে পারবেনঃ
১. প্রণাম কাকে বলে?
২. প্রণাম কত প্রকার?
৩. কোনটি উত্তম প্রণাম?
৪. প্রণাম করার কিছু বিধিনিষেধ
গীতায় ভগবান বলেছেনঃ
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।। ১৮/৬৫

অনুবাদঃ তুমি সর্বদা আমার স্মরণ কর,আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর এবং আমাকে নমস্কার কর।তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এই বিষয়ে আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি,যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়।

গীতার গান (অধ্যায়-১৮/শ্লোক-৬৫)

মন্মনা মদ্ভক্ত হও মোরে নমস্কার। 
আমাকে পাইবে তুমি প্রতিজ্ঞা আমার।।

প্রণাম বিধি - শাস্ত্রমতে প্রণামের প্রকারভেদ এবং কাকে, কিভাবে প্রণাম করা উচিত?

প্রণাম কাকে বলে?

প্রণাম শব্দটি তৎসম শব্দ, অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। সংস্কৃতে 'প্র' উপসর্গযুক্ত 'নম্' ধাতু থেকে প্রণাম শব্দটির উৎপত্তি। এখানে 'প্র' উপসর্গটি কোনোকিছুর উৎকর্ষ প্রসিদ্ধির আধিক্য এবং 'নম্' ধাতু দ্বারা "আনমিত বা প্রসারণ" অথবা "নমিত বা নত" হওয়াকে বোঝায়।

অর্থাৎ প্রণাম অর্থ আমরা বলতে পারি, কোনকিছুর উপর প্রকৃষ্টরূপে বা সর্বোচ্চ উৎকৃষ্টভাবে আনমিত বা নত হওয়া। সংস্কৃতির দিক থেকে এটি "সম্মান সূচক অভিবাদন" হিসেবে গণ্য হয়।

প্রণাম বলতে "শ্রদ্ধাপূর্বক ভক্তি" সহকারে ভগবান, দেব-দেবী, গুরুদেব, মা-বাবা, গুরুজন, বয়জ্যেষ্ঠ এবং আরো অনেকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সহিত আত্মিক উন্নতির প্রার্থনাকে বোঝায়।

সম্মানসূচক আমরা পাঁচ(৫) ভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকি।যেমনঃ

১. প্রত্যুত্থান (স্বাগত জানাতে উঠে দাঁড়ানো)
২. নমস্কার (হাত জোড় করে সম্মোধন করা)
৩. উপসংগ্রহণ (বয়জ্যেষ্ঠদের পা ছোঁয়া)
৪. প্রণাম (সাষ্টাঙ্গ/পঞ্চাঙ্গ/ত্র্যঙ্গ)
৫. প্রত্যাভিবাদন (অভিনন্দনের ফলে অভিনন্দন জানানো)

প্রণাম কত প্রকার? 

শাস্ত্র অনুযায়ী প্রণাম তিন(৩) প্রকার। যথাঃ
১. সাষ্টাঙ্গ প্রণাম (অষ্টাঙ্গ প্রণাম/দন্ডবত প্রণাম) 
২. পঞ্চাঙ্গ প্রণাম 

৩.ত্র্যঙ্গ প্রণাম ।

উল্লেখ্য যে, সাষ্টাঙ্গ প্রণাম শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য এবং পঞ্চাঙ্গপ্রণাম পুরুষ ও মহিলা উভয়ই করতে পারবেন। এবিষয়ে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে,

ব্রাহ্মণস্য গুদম শঙ্খ শালিগ্রামম চ পুস্তকম।
বসুন্ধরা ন সহিতে কামিনী কুছ মদর্ন।। ধর্মসিন্ধু

অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের পিছনের অংশ, শঙ্খ, শালিগ্রাম, শাস্ত্র(গ্রন্থ) এবং মহিলাদের স্তন সরাসরি মাটিতে স্পর্শ করে,তবে পৃথিবী ভার বহন করতে পারে না। তাই দন্ডবত(সাষ্টাঙ্গ/অষ্টাঙ্গ) প্রণাম মহিলাদের বিধি নয়।

অষ্টাঙ্গ প্রণাম

পদ্ভ্যাং করাভ্যাং জানুভ্যামুরসা শিরসা দৃশা। 
বচসা মনসা চৈব প্রণামোহষ্টাঙ্গ-ঈরিতঃ।। তন্ত্রসার

অর্থাৎ পাদদ্বয়, হস্তদ্বয়,  জানুদ্বয়, বক্ষঃ, মস্তক, চক্ষুঃ, বাক্য ও মন এই অষ্ট অঙ্গ দ্বারা প্রণামকে অষ্টাঙ্গপ্রণাম বলে।

পঞ্চাঙ্গ প্রণাম

বাহুভ্যাঞ্চৈব জানুভ্যাং শিরসা বচসা দৃশা।
পঞ্চাঙ্গোহয়ং প্রণামঃ স্যাৎ পূজাস্যু প্রবরাবিমো।।তন্ত্রসার

অর্থাৎ বাহুদ্বয়, জানুদ্বয়, মস্তক, বাক্য ও চক্ষুঃ এই পঞ্চ অঙ্গ দ্বারা প্রণামকে পঞ্চাঙ্গপ্রণাম বলে।

বিষ্ণুতত্ত্ব,বিভিন্ন দেব-দেবী এবং গুরুজনদের কিভাবে প্রণাম করা উচিত?
এবিষয়ে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে,

"স্ববামে প্রণমেদ্বিষ্ণু দক্ষিণে শক্তি শঙ্করৌ।
প্রণমেচ্চ গুরুরোগ্রে চান্যথা নিস্ফলং ভবেৎ।।"
-পুরোহিত দর্পণ পৃঃ ৪৭

অর্থাৎ শ্রী শ্রী বিষ্ণুকে বামে, শক্তি-বিষয়ক দেবী ও শঙ্করকে দক্ষিণে এবং গুরুদেবকে অগ্রে রেখে প্রণাম করতে হয়। অন্যথায় এটি হবে নিস্ফল।

কোনটি উত্তম প্রণাম?

শাস্ত্রে পাওয়া যায়-

"ত্রিবিধে চ নমস্কারে কায়িকশ্চত্তোম স্মৃতঃ।
কায়িকৈস্তু নমস্কারৈদের্বাস্তুষ্যন্তি নিত্যশঃ।।"
-কালিকা পুরাণ, ৭১/৭২,পৃঃ ৭২৩

অর্থাৎ তিনপ্রকার প্রণাম বা নমস্কারের মধ্যে কায়িক(দণ্ড বা সাষ্টাঙ্গ) প্রণাম সর্বশ্রেষ্ঠ। এই কায়িক প্রণাম দ্বারাই দেব-দেবী সর্বদা সন্তুষ্ট হ'ন।

প্রণাম করার কিছু বিধিনিষেধ

একহস্তপ্রণামশ্চ একং বাপি প্রদক্ষিণম্।
অকালে দর্শনং বিষ্ণোর্হান্ত পুণ্যং পুরাকৃতম্।।
অর্থাৎ একহস্ত প্রণাম, একবার প্রদক্ষিণ ও অকালে বিষ্ণুদর্শন ইহাতে পূর্ব্বকৃত পুণ্য বিনষ্ট হয়। 

তাই আসুন আমরা শাস্ত্র অনুযায়ী ভগবান সহ অন্যান্য সকলকেই যথোচিত উপায়ে ভক্তি তথা প্রণাম নিবেদন করি। এইরকম তথ্য নির্ভর আরো পোস্ট পেতে নিয়মিত ভিজিট করুন । এই সকল তথ্য সবাইকে জানাতে শেয়ার করুন। হরেকৃষ্ণ 🙏

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url