শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ লীলা | Mahaprasad in Jagannath Puri
ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ লীলা সম্পর্কে "শ্রীল লোচন দাস ঠাকুর রচিত চৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থে বর্ণিত লীলা" আস্বাদন করুন।
শ্রীল লোচন দাস ঠাকুর রচিত,চৈতন্যমঙ্গল গ্রন্থে বর্ণিত লীলা
একবার নারদ মুনি বৈকুণ্ঠে গিয়ে মনোযোগ সহকারে লক্ষ্মীদেবীর সেবা করেছিলেন। লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন এবং নারদ মুনিকে যেকোনো বর চাইতে বললেন। নারদ মুনি উত্তরে বললেন, "হে মাতা লক্ষ্মী, আপনাকে প্রথমে অবশ্যই এই প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে আমি যে বর প্রার্থনা করব, আপনি সেই বর দেবেন।" লক্ষ্মীদেবী শপথ করলেন যে তিনি সানন্দে তাঁর প্রিয় পুত্র নারদের যেকোনো মনোবাসনা পূর্ণ করবেন। তখন মহান ঋষি নারদ তাঁর অভিলাষ ব্যক্ত করলেনঃ
লক্ষ্মীদেবী যেন তাঁকে শ্রীনারায়ণের ভুক্তাবশেষ মহাপ্রসাদ তাকে প্রদান করেন।একথা শ্রবণমাত্র লক্ষ্মীদেবীর ভাবান্তর হল, তাঁর কোমল মুখে দেখা দিল উৎকণ্ঠার ছায়া। "হে নারদ, প্রভুর প্রসাদ ছাড়া আমার কাছে অন্য কিছু চাও," তিনি অনুনয় করে বললেন।
"কয়েকদিন পূর্বে প্রভু কাউকে তাঁর প্রসাদ প্রদান না করার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তোমাকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে আমি আমার পতিদেবের আজ্ঞা লঙ্ঘন করতে পারি না।সেজন্য, প্রিয় পুত্র, তোমাকে আমি প্রসাদ দিতে পারছি না।"নারদ মুনি কিন্তু তাঁর সঙ্কল্পে অত্যন্ত অনড়, অটল রইলেন এবং দেবীকে তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করালেন। "হে মাতা, আপনি শ্রীনারায়ণের প্রিয় ভার্যা", নারদ মুনি সানুনয়ে বললেন। "সুতরাং অবশ্যই আমাকে এই বর আপনাকে দান করতে হবে। যেকোন উপায়ে আমাকে প্রভুর মহাপ্রসাদ আপনাকে দিতেই হবে।"লক্ষ্মীদেবী অত্যন্ত সংকটে পড়লেন। কি করা যায়, তিনি ভাবতে লাগলেন। নারদ মুনিকে তিনি প্রতীক্ষা করতে বললেন, ততক্ষণে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য কি করা যায়, তিনি তাঁর উপায় সন্ধান করবেন।
মধ্যাহ্নে মাতা লক্ষ্মী তাঁর স্বামী শ্রীনারায়ণকে প্রীতি সহকারে মধ্যাহ্নভোজ পরিবেশন করলেন। যদিও লক্ষ্মীদেবী একাগ্রতা ও নিপুণতার সঙ্গে তাঁর কর্তব্যকর্ম সাধন করছিলেন,তবুও প্রভু লক্ষ্য করলেন যে তাঁর ভার্যার মনে যেন প্রফুল্লতা নেই, অত্যন্ত অসুখী। তাঁর মুখমণ্ডলও বিষণ্ন হয়ে উঠেছিল। শ্রীনারায়ণ কোমলস্বরে তাঁর মনোবেদনার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ভগবানের চরণকমলে পতিত হয়ে লক্ষ্মীদেবী তাঁর অবস্থার কথা জানালেন।শ্রীনারায়ণ করুণাপূর্ণচিত্তে তাঁর ক্রন্দনরতা দয়িতাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন, "কেবল আজকের জন্য আমি নিয়মটি শিথিল করছি। তুমি আমার ভুক্তাবশেষ সহ ভোজন পাত্রটি নিয়ে নারদকে দিতে পারো। কিন্তু তুমি এমনভাবে তাঁকে প্রসাদ অর্পণ করবে যেন আমি না দেখতে পাই। যখন আমি অন্য দিকে মুখ ফেরাব, তখন তুমি ভোজন পাত্রটি সরিয়ে নেবে, যেন আমি জানি না।" একথা শ্রবণে দেবী আনন্দিত হলেন। তাঁর প্রিয় পতির আজ্ঞা অনুসারে তিনি নিপুণতার সঙ্গে প্রভুর ভুক্তাবশেষ-যুক্ত ভোজন পাত্রটি সরিয়ে নিলেন, যখন তিনি লক্ষ্য করছিলেন না।লক্ষ্মীদেবী তৎক্ষণাৎ মহাপ্রসাদ পাত্রটি নিয়ে নারদমুনিকে অর্পণ করলেন। নারদ মুনি আনন্দোচ্ছ্বল চিত্তে নৃত্য করতে করতে ভুক্তাবশিষ্ট প্রসাদ গ্রহণ করলেন। তিনি যখন শ্রীনারায়ণের প্রসাদ আস্বাদন করছিলেন, তখন তাঁর ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন ও মহানন্দে নৃত্যে এক মুহূর্তও বিরতি দিলেন না। আর প্রসাদ গ্রহণের ফলে তাঁর দিব্য ভাবোচ্ছ্বাস, প্রেমাবেশ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল, অবশেষে তিনি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। নারদ মুনি তাঁর বীণা হস্তে উন্মত্তের মতো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র পরিভ্রমণ করতে লাগলেন।
অবিশ্রান্তভাবে নৃত্য-কীর্তন করতে করতে তিনি ব্রহ্মাণ্ডের এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ভ্রমণ করতে লাগলেন।অবশেষে তিনি মহাদেব শিবের আবাসস্থান কৈলাসে এসে উপনীত হলেন। নারদ মুনিকে এমন ভাবোল্লাসে মগ্ন হয়ে নৃত্য-কীর্তন করতে দেখে শিব বিস্ময়াভিভূত হলেন। বিষ্ণুভক্তির সাগরতরঙ্গে সন্তরণরত নারদমুনি শিবকে দেখতেই পাননি। শিব দিব্য ভাবাবিষ্ট নারদ মুনিকে সান্ত্বনা দিলেন, "নারদ, আমি জানি যে তুমি সবসময় প্রেমাবেশমগ্ন থাক, কেননা তুমি অনুক্ষণ শ্রীনারায়ণের পবিত্র নাম কীর্তন কর। কিন্তু আমি কখনো তোমাকে এমন অবস্থায় দর্শন করিনি। তোমার কি হয়েছে?" তখন নারদ মুনি কিছুটা আত্মস্থ হলেন এবং সব কিছু বিশদে বললেন।"ভগবানের মহাপ্রসাদ গ্রহণ করার পর আমি এতই আনন্দ ও ভাব লাভ করি যে আমি নৃত্য ও কীর্তন বিরত রাখতে অক্ষম হয়ে পড়েছি," নারদ মুনি সোল্লাসে বললেন। শ্রীশিব তখন করজোড়ে নারদমুনিকে বললেন, "হে নারদ! তুমি শ্রীনারায়ণের মহাপ্রসাদ আস্বাদন করেছ, তুমি কতই না সৌভাগ্যবান।" শিবশম্ভু আশান্বিত চিত্তে স্মিত হেসে বললেন, "প্রিয় নারদ, আমার জন্য কোনো প্রসাদ নিয়ে এসেছ কি?"
নারদ মুনি অত্যন্ত দুঃখিত হলেন, কেননা শ্রীশিবের জন্য তিনি কোনো প্রসাদ নিয়ে আসতে পারেননি। মস্তক অবনত করে নারদ করজোড়ে শ্রীশিবের সামনে অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে তাঁর আঙুলের নখাগ্রে এক কণা প্রসাদ লেগে রয়েছে। তিনি সোল্লাসে বললেন, "হ্যাঁ এই তো! এখানে মহাপ্রসাদ রয়েছে। প্রসাদ কণিকামাত্ৰ ৷ এক কণা প্রসাদ আপনার জন্যই।"নারদ মুনি সযত্নে তাঁর হাত শিবের দিকে প্রসারিত করলেন, যাতে তিনি প্রসাদ কণা দেখতে পান। "হে শিব, আপনি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। অনুগ্রহ করে এই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করুন।"নারদ মুনি শিবের মুখে তাঁর হাতের আঙুল প্রবেশ করালেন। সেই ক্ষুদ্র প্রসাদ-কণা মহাদেবের জিহ্বার স্পর্শ হওয়া মাত্র তিনি মহা সুখ ও প্রবল প্রেমোচ্ছ্বাস এতটাই অনুভব করলেন, যে তিনি আর শান্ত থাকতে পারলেন না। শ্রীশিব কীর্তন ও নৃত্য করতে শুরু করলেন। যতই তাঁর প্রেমোচ্ছ্বাস বাড়তে থাকল, তাঁর নৃত্যও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল।
এইভাবে তাঁর নৃত্য-উন্মাদনা এতই প্রবল হয়ে উঠল যে তিনি প্রলয়কালীন তাণ্ডব নৃত্য করা শুরু করলেন। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড কম্পিত হতে শুরু করল। প্রত্যেকেই ভীত হয়ে ভাবতে লাগল, "কি ঘটছে? এই অসময়ে এই নৃত্য হচ্ছে কেন? এখন তো প্রলয়ের সময় আসেনি!" শিবজীকে সেই প্রলয়নৃত্য হতে নিবৃত্ত করার কারোরই সাহস হল না। তখন দেবগণ মাতা পার্বতীর কাছে অনুরোধ করলেন প্রভুকে নিবৃত্ত করার জন্য, অন্যথায় সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। মাতা পার্বতী তখন অকুস্থলে আবির্ভূতা হলেন এবং শ্রীশিবকে অমেয় ভাবোল্লাসে নৃত্য করতে দেখলেন। মাতা পার্বতী বিনম্রচিত্তে শ্রীশিবের নিকট গেলেন।
যখন শিবের বাহ্যচেতনা ফিরে এল, তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, "হে প্রিয় স্বামী! আপনার কি হয়েছে? কিসের কারণে আপনি এমন মহা প্রেমাবেশে নৃত্য করছেন?" শিব কারণ প্রকাশ করে বললেন যে তিনি নারদ মুনির নিকট থেকে শ্রীনারায়ণের মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেছেন। পার্বতীদেবী বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। প্রসাদ গ্রহণের আকাঙ্খায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "হে স্বামী, আপনি আমার জন্য কিছু মহাপ্রসাদ রেখেছেন তো? শিব উত্তর দিতে পারলেন না। তিনি নারদের কাছ থেকে কেবল এক কণামাত্র প্রসাদ পেয়েছিলেন। কিভাবে তিনি প্রসাদ রেখে দেবেন? মহাপ্রসাদ পাবেন না জেনে পার্বতী ক্রুদ্ধ হলেন। "আমি শ্রীনারায়ণের প্রসাদ হতে বঞ্চিত!" তাঁর ক্রোধ এতই বাড়তে লাগল যে সেই ক্রোধাগ্নি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড উত্তপ্ত করতে আরম্ভ করল। নিম্নলোক হতে ঊর্ধ্বলোক পর্যন্ত ত্রিভুবনের সকলেই সেই তাপ অনুভব করতে লাগল। সাধু-ঋষিগণ অনুভব করলেন যে মাতা পার্বতীর ক্রোধাগ্নিতে সবকিছু ধ্বংস হতে চলেছে। কেউ তাঁর ক্রোধ প্রশমিত করতে পারলেন না। অবশেষে ব্রহ্মার নেতৃত্বে সকল দেবগণ ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে সব কিছু জানাতে ত্রস্তভাবে বৈকুণ্ঠে গমন করলেন।
পরিস্থিতির কথা শ্রবণ করে ভগবান গরুড়ের পিঠে আরোহণ করে অবিলম্বে কৈলাসে উপনীত হলেন। যখনই পার্বতী দেবী শ্রীনারায়ণকে দর্শন করলেন, তিনি তাঁকে প্রণিপাত করতে এগিয়ে এলেন। শ্রীনারায়ণ তাঁর ভক্তকে আশীর্বাদ করে বললেন,"আমি তোমাকে যত তুমি চাও তত পরিমাণে মহাপ্রসাদ দেব। এখন দয়া করে শান্ত হও এবং ক্রোধ সংবরণ কর। অন্যথায় তোমার সকল সন্তান বিনাশপ্রাপ্ত হবে।"
কিন্তু মাতা পার্বতী প্রতিবাদ করলেন, "কিন্তু আপনি যদি কেবল আমাকে আপনার মহাপ্রসাদ প্রদান করেন, আমি তাতে পরিতৃপ্ত হব না। আমার সকল সন্তান-সন্ততি, সকল জীবকে আপনার মহাপ্রসাদ দান করতে আপনাকে অনুরোধ করছি। মহাপ্রসাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আমি যেমন কষ্ট পাচ্ছি, আমি চাই না যে আমার কোনো সন্তান এইভাবে কষ্ট পাক,দুর্দশাগ্রস্ত থাকুক। হে প্রভু! আপনাকে অবশ্যই এমন কোনো ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সকল জীব, এমনকি কুকুরও আপনার মহাপ্রসাদ গ্রহণ করতে পারে।"শ্রীনারায়ণ স্মিত হেসে বললেন, "তথাস্ত! তাই হবে। হে পার্বতী, তোমার অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য আমি নীলাচল ধামে আবির্ভূত হব। আমার মন্দির প্রসাদ বিতরণের জন্য ভুবনে প্রসিদ্ধ হবে। যে-ই আমার প্রসাদ গ্রহণ করবে সেই মুক্তি লাভ করবে। আমার সকল প্রসাদ প্রথমে তোমাকে নিবেদন করা হবে। তখন সেই ভুক্তাবশেষ মহাপ্রসাদে পরিণত হবে। এই মহাপ্রসাদ উচ্চ-নীচ ভেদে সকলকে বিতরণ করা হবে। মন্দিরে আমার সন্নিকটে তোমার অবস্থিতি হবে। মন্দির অঙ্গনের অভ্যন্তর ভাগে আমার মন্দিরের পিছনেই তোমার মন্দির থাকবে। শ্রীশিব তোমাকে মহাপ্রসাদ দানে উপেক্ষা করার জন্য কিছুটা দূরে অবস্থান করবেন। তাঁর মন্দির থাকবে অঙ্গনের বাইরে।
ভগবান পুরীতে জগন্নাথরূপে প্রকটিত হলেন। পার্বতীদেবী সেখানে বিমলাদেবী নামে খ্যাত হয়ে পার্শ্ববর্তী মন্দিরে বিরাজিত। জগন্নাথের প্রসাদ প্রথমে তাঁর ভক্ত বিমলাদেবীকে নিবেদন করা হয়। তখন সেই প্রসাদ মহাপ্রসাদ হয় এবং অন্য সকলকে বিতরণ করা হয়। পুরীতে জগন্নাথ মহাপ্রসাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো উচ্চ-নীচ জাতি-বিচার নেই। জগন্নাথ মহাপ্রসাদ এতই পবিত্র যে, শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে এমনকি একজন ব্রাহ্মণও একটি কুকুরের মুখ থেকে নিয়ে ঐ মহাপ্রসাদ গ্রহণ করতে পারেন। এই মহাপ্রসাদ কখনই অপবিত্র হয় না।
সুত্রঃ শ্রীজগন্নাথদেবের লীলাকথামৃত