একাদশী কী? একাদশী পালনের নিয়ম, একাদশী মাহাত্ম্য ২০২২
প্রথমেই বলে নিই, একাদশী কী?
উত্তরঃ একাদশী একটি চান্দ্র তিথি। চাঁদের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথি, হিন্দু ধর্মমতানুসারে পুণ্যতিথি হিসেবে বিবেচিত। হিন্দুধর্মমতে নিরম্বু উপবাস বিহিত। একাদশী ব্রত অবশ্য পালনীয়।
শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড়া প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট রয়েছে। তাই মায়া তাকে এ জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে।
পরম করুণাময় ভগবান কৃষ্ণস্মৃতি জাগরিত করতে মায়াগ্রস্ত জীবের কল্যাণে বেদপুরাণ আদি শাস্ত্রগ্রন্থাবলী দান করেছেন। ভক্তি হচ্ছে ভগবানকে জানার ও ভগবৎ প্রীতি সাধনের একমাত্র সহজ উপায়। শাস্ত্রে যে চৌষট্টি প্রকার ভক্ত্যাঙ্গের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একাদশী ব্রত সর্বোত্তম।
শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ আদি নবধা ভক্তির পরই দশম ভক্ত্যাঙ্গরূপে একাদশীর স্থান। এই তিথিকে হরিবাসর বলা হয়। তাই ভক্তি লাভেচ্ছু সকলেই একাদশী ব্রত পালনের পরম উপযোগীতার কথা বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। একাদশী তিথি সকলের অভীষ্ট প্রদানকারী। এই ব্রত পালনে সমস্ত প্রকার পাপ বিনষ্ট, সর্বসৌভাগ্য ও শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধান হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আট থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত যেকোন ব্যক্তিরই ভক্তিসহকারে পবিত্র একাদশী ব্রত পালন করা কর্তব্য।
লক্ষ্য করুনঃ
সঙ্কটজনক অবস্থা বা জন্মমৃত্যুর অশৌচে কখনও একাদশী পরিত্যাগ করতে নেই। একাদশীতে শ্রাদ্ধ উপস্থিত হলে সেইদিন না করে দ্বাদশীতে শ্রাদ্ধ করা উচিত। শুধু বৈষ্ণবেরাই নয়, শিবের উপাসক, সূর্য- চন্দ্ৰ-ইন্দ্ৰাদি যেকোন দেবোপাসক, সকলেরই কর্তব্য একাদশী ব্রত পালন করা। দুর্লভ মানবজীবন লাভ করেও এই ব্রত অনুষ্ঠান না করলে বহু দুঃখে-কষ্টে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করতে হয়।
জেনে নিনঃ নিম্নোক্ত বিষাবলী
- শুদ্ধ ভাবে একাদশী পালনের নিয়ম
- একাদশীতে কি কি খাবারে নিষেধাজ্ঞা আছে ?
- একাদশী পারনের নিয়ম কি?
- একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য কি ?
- কোন কোন নিয়ম পালন করতেই হবে, সেই নিয়ম কি কি ?
- এবং একাদশী না থাকলে কি করতে হবে?
আসুন জেনে নিই সেই সব নিয়মগুলো এবং বিধি নিষেধ গুলি
1. সমর্থ পক্ষে দশমীতে একাহার,
2. একাদশীতে নিরাহার, ও দ্বাদশীতে একাহার করিবেন।
3. তা হতে অসমর্থ পক্ষে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার করিতে হয়।
4. যদি উহাতেও অসমর্থ হন, একাদশীতে পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করিবেন। ফল মুলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রইয়াছে।
5. সমর্থপক্ষে রাত্রি জাগরণের বিধি আছে।
6. মহান গোস্বামীগন ও আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত তালিকা বা পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা ব্রত পালনের (জল ব্যতীত) পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন, সেগুলি সেই মতেকরলে সর্বোত্তম হয়। নিরন্তর কৃষ্ণ ভজনায় থেকে নিরাহার থাকতে । একান্ত অপারগ হলে নির্জলা সহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু সবজি, ফলমূল গ্রহণ করতে পারবেন।
যেমন : গোল আলু, মিষ্টি আলু, চালকুমড়ো,পেঁপে,টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি,ঘি অথবা বাদাম তেলে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে, আহার করতে পারেন। হলুদ মরিচ, লবন ব্যবহার্য। আবার অন্যান্য আহার্য যেমনঃ দুধ, কলা,আপেল, আঙুর, আনারস, আঁখ, আমড়াশস্য তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু, বাদাম, লেবুর শরবত ইত্যাদি ফলমূল খেতে পারেন।
একাদশীতে পাঁচ প্রকার রবিশস্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছেঃ
1. ধান জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমনঃ চাল,মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি ,চালের পিঠা,খৈ,ইত্যাদি
2. গম জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমনঃ আটা,ময়দা, সুজি, বেকারির বিস্কুট, বা সকল প্রকার বিস্কুট, বেকারির রুটি,হরলিক্স জাতীয় ইত্যাদি।
3. যব বা ভূট্টা জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমনঃ ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি।
4. ডাল জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমনঃ মুগ,মসুরী, মাসকলাই, খেসারী, ছোলা, অড়হর,ফেনল, মটরশুঁটি, বরবটি, সিম ইত্যাদি।
5. সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, তিল তেল,ইত্যাদি । উপরোক্ত পঞ্চ রবি শস্য যেকোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয় । উল্লেখ্য যারা সাত্বিক আহারী নন, এবং চা,বিড়ি, সিগারেট, পান, কফি, নেশা গ্রহণ করেন একাদশী ব্রত পালনের সময়কাল পর্যন্ত এই সব গ্রহণ না করাটাই ভালো ।
একাদশী ব্রত মাহাত্ম্যঃ
একাদশী করলে যে কেবলমাত্র নিজের জীবন এর সদগতি হয় তা নয়, একাদশী ব্যক্তির প্রয়াত পিতা/ মাতা নিজ কর্মদোষে নরকবাসী হন, তবে সেই পুত্রই পিতা/ মাতা কে নরকের থেকে উদ্ধার করতে পারবে।একাদশীতে অন্ন ভোজন করলে যেমন নরকবাসী হবে, তেমনই অন্যকে অন্নভোজন করালেও নরকবাসী হবে। কাজেই একাদশী ব্রত পালন করা আমাদের সকলের কর্তব্য।
সম্পূর্ণ একাদশী ব্রত মাহাত্ব্য পড়ুন
একাদশী পারনঃ
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর নিয়ম একাদশী পারনের। (উপবাসের পরদিন সকালে ) যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করে পারন করা একান্ত ভাবে দরকার। নতুবা একাদশীর কোনো ফল লাভ হবেনা । একাদশী ব্রত পালনের একমাত্র প্রকৃত উদ্দেশ্যে কেবল উপবাস করা নয়। নিরন্তর ভগবান এর নাম স্মরণ, মনন, ও শ্রবন কীর্তনের মাধ্যমে একাদশীর দিন অতিবাহিত করতে হয়। এই দিন যতটুকু সম্ভব উচিত একাদশী পালনে পরনিন্দা, পরচর্চা, মিথ্য ভাষন, ক্রোধ, দুরাচারী, স্ত্রী সহবাস, সম্পুর্ন রূপে নিষিদ্ধ।
বিঃ দ্রঃ নিন্মক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি বাঞ্ছনীয়
একাদশী ব্রতের আগের দিন রাত ১২ টার আগেই অন্ন ভোজন সম্পন্ন করে নিলে সর্বোত্তম। ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাত ব্রাশ করে দাত ও মুখে লেগে থাকা অন্ন পরিস্কার করে নেওয়া উচিত। সকালে উঠে শুধু মুখ কুলি ও স্নান করতে হয়। একাদশীর সময় সবজি কাটার থেকে সতর্ক থাকতে হবে। যেনো কোথাও কেটে না যায়। একাদশী তে রক্তক্ষরণ বর্জনীয়। দাত ব্রাশ করার সময়কালে ও রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। তাই আগের দিনই দাত ব্রাশ করা সর্বোত্তম। একাদশীতে চলমান একাদশীর মাহাত্ম্য ভগবদ্ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রবন অথবা সম্ভব না হলে নিজেই ভক্তিসহকারে পাঠ করতে হয়। যারা একাদশীতে একাদশীর রান্না করেন তাদের পাঁচ ফোড়ন ব্যবহার থেকে সতর্ক থাকা উচিত । কারন পাঁচ ফোড়নে সরিষার তেল, তিল থাকতে পারে, যা বর্জনীয়। একাদশী তে শরীরে প্রসাধনীর ব্যবহার নিষিদ্ধ।
তৈল, সুগন্ধী সাবান, শ্যাম্পু, ইত্যাদি বর্জনীয়। সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম, শেভ, চুল, নখ,কাটা নিষিদ্ধ।
একাদশী না থাকলে কি করবেন তাও জেনে নিনঃ
একাদশী না থাকা কালীন আপনি যে খাবার গ্রহণ করবেন অর্থাৎ খাদ্য শস্য গ্রহণ করবেন তা আপনি খাবেন না, তা খাবার নয় পাপ ভক্ষণ করবেন। কারন মাত্র ১টি খাদ্য শস্যের মধ্যে চার ধরনের পাপ থাকে পাপ গুলো কি কি দেখুনঃ
১। মাতৃ হত্যার পাপ।
২। পিতৃ হত্যার পাপ।
৩। ব্রহ্ম হত্যার পাপ।
৪। গুরু হত্যার পাপ।
আপনিই মাত্র টি দানা নয় প্রতি গ্রাসে হাজার হাজার দানা ভক্ষণ করবেন। ভেবে দেখুন যে পাপ কাজ আপনি করেন নি সেই পাপ কাজের ভাগীদার আপনাকে হতে হবে। যদি আপনি একাদশীর সময় খাদ্যশস্য গ্রহণ করেন। আর ঠিক তেমনই নিজে খেলে যে পাপ হবে অন্যকে খাওয়ালেও সেই একই পাপ হবে। তাই একজন সনাতনী হিসাবে আপনার একাদশী থাকা উচিত না অনুচিত নিজেই বিচার করুন।
একাদশী পারন মন্ত্র
একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব ॥
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্ৰদো ভব৷